ইউক্রেনের অলিভিয়া সমুদ্রবন্দরে নোঙর করে থাকা ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের নাবিক-ক্রুদের জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে স্বজনদের। বুধবার রাতে বাংলাদেশি এই জাহাজে রকেটের আঘাতে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান নিহত হন। এই খবরে দেশে থাকা অন্য নাবিক-ক্রুদের স্বজনের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেছে।
তবে আশ্বস্ত হওয়ার মতো খবর হলো, ওই জাহাজের ২৮ নাবিক ও ক্রু এবং নিহত হাদিসুর রহমানের মরদেহ জাহাজ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তারা সবাই এখন নিরাপদ স্থানে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
সাতক্ষীরা: চরম অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগে দিন পার করছে ইউক্রেনে আটকে থাকা বাংলাদেশি জাহাজের চিফ অফিসার সাতক্ষীরার মুনসুরুল আমীন খানের পরিবার।
সাতক্ষীরা পৌরসভার উত্তর কাটিয়ায় মুনসুরুল আমীনের স্ত্রী আশকুরা সুলতানা তার স্বামীর বরাত দিয়ে জানান, কৃষ্ণসাগরের অলিভিয়া বন্দরে নোঙ্গর করা অবস্থায় ‘বাংলার সমৃদ্ধ’ জাহাজের ব্রিজে একটি রকেট এসে পড়লে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। এতে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মারা যান। জাহাজের ডেক বিধ্বস্ত হয়ে যায়। রাডারও কাজ করছে না। জ্বালানি সংকটেও পড়েছে জাহাজটি।
চিফ অফিসার মুনসুরুল আমীন খান। ছবি: সংগৃহীত
মুনসুরুল আমীন বৃহস্পতিবার দুপুরে ভয়েস কলে পরিবারকে জানান, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মরদেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। তার মৃত্যু আমাদেরকে পীড়া দিচ্ছে।
মুনসুরুল আমীনের পিতা বিএডিসির সাবেক কর্মকর্তা নুরুল আমীন খান জানান, মুনসুরুল আমীন ইউক্রেন থেকে এই জাহাজেই ক্যাপ্টেন হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল। তার খুবই আশা ছিল, ক্যাপ্টেন হিসেবে সাতক্ষীরাতে ফেরার। সেটা হলো না। আমরা শুধু এখন প্রত্যাশা করি, নিরাপদে তারা বাড়ি ফিরুক।’
কুষ্টিয়া: বাংলার সমৃদ্ধিতে আটকে পড়া নাবিকদের একজন কুষ্টিয়ার যুবক ফয়সাল আহমেদ সেতু। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় তিনি বাবার মেসেঞ্জারে লিখেছেন- চিন্তা কইরেন না, ভাল আছি।
সেতুর বাবা কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খাস মথুরাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ বিশ্বাস এ কথা জানিয়ে তার ছেলেসহ সব নাবিকের জন্য দেশবাসীর দোয়া চেয়েছেন। ফারুক বিশ্বাস এ ব্যাপারে ফেসবুকে একটি পোস্টও দিয়েছেন। তিনি দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমার ছেলে রকেট-বোমা হামলায় আহত হয়েছে।’
ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ছেলেকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে-মধ্যে মেসেঞ্জারে অ্যাকটিভ দেখা যাচ্ছে। মেসেজ বা অডিও কল দিলে রিপ্লাই আসছে না।
‘ওর মা হার্টের রোগী, সে কারণে হয়তো কিছু বলছে না। সবশেষ গত মাসের ২২ তারিখে ফোনে কথা হয়েছিল ইউক্রেন পৌঁছানোর আগে। এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি। টুকটাক কথা আদান-প্রদান হয়েছে মেসেঞ্জারে।’
নাবিক ফয়সাল আহমেদ সেতু। ছবি: সংগৃহীত
ফারুক বলেন, ‘আমরা খুবই চিন্তিত। তবে আশাবাদী। টেলিভিশনে আপডেট দেখছি। দেখলাম তাদের উদ্ধার করে পোল্যান্ডে নেয়া হচ্ছে।
‘আমরা খুশি যে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিতে বলেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ওখানে কথা বলেছেন। ছেলেসহ যারা আছে সবাই যাতে ফিরে আসতে পারে সেজন্য সবার দোয়া চাইছি।’
ফারুক আহমেদ জানান, তার ছেলে ফয়সাল আহমেদ সেতু খুলনা পাবলিক কলেজে পড়েছেন। আর মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতেও পড়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে ডেক ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।
ময়মনসিংহ: ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের নাবিক-ক্রুদের মধ্যে থার্ড অফিসার রুকনুজ্জামান রাজীব বাড়ি ময়মনসিংহের নগরীর কাঁচিঝুলি এলাকার মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ছেলে।
বড় ভাই কামরুজ্জমান রাসেল নিউজবাংলাকে জানান, রাজিব ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ১৫৭তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন। চার মাস আগে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে থার্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেন রাজিব। তার দুই বছর বয়সী একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।
থার্ড অফিসার রুকনুজ্জামান রাজিব। ছবি: সংগৃহীত
রাসেল আরো জানান, রাজিব একটি ভিডিও পাঠিয়েছেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, জাহাজের অন্ধকার একটি জায়গা থেকে তারা বলছেন- আমরা এখন নিরাপদে নেই। ওই ভিডিও বার্তায় দেশে ফিরে আসার তীব্র আকুতি জানিয়েছেন রাজিবসহ অন্যরা।
রাজিবের স্ত্রী সিলভিয়া জাহান বলেন, ‘শুধু এসএমএসে যোগাযোগ করতে পারছি। সে দেশে ফেরার জন্য কান্নাকাটি করছে। আমার স্বামীকে সুস্থ অবস্থায় দেশে ফেরত চাই।’
রাজিবসহ জাহাজের সবার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন রাজিবের মা কোহিনুর বেগম।
টাঙ্গাইল: বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে আটকা পড়া টাঙ্গাইলের রবিউল আউয়াল বাঁচার আকুতি জানিয়ে বড় ভাইকে মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েছেন। লিখেছেন, ‘ভাই, আমরা আতংকিত। আমরা বাঁচতে চাই, দেশে ফিরতে চাই’।
রবিউল ওই জাহাজের সহকারী প্রকৌশলী। তিনি দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামের মো. হোসেন আলীর ছেলে।
সহকারী প্রকৌশলী রবিউল আউয়াল। ছবি: সংগৃহীত
বড় ভাই আজিজুল হক খান জানান, জাহাজে বর্তমানে ২৮জন বাংলাদেশি নাবিক-ক্রু রয়েছেন। তারা সবাই আতংকে আছেন।
রবিউলের বাবা উদ্বেগভরা কণ্ঠে বলেন, ‘আমি সরকারের কাছে আকুতি জানাই আমার ছেলেকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনুক।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে রকেট হামলার পর উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠান নাবিকেরা। ভিডিওতে আসিফুল ইসলাম নামে এক নাবিক বলেন, ‘আমাদের বাঁচান। কোনো জায়গা থেকে আমাদের বাঁচাতে সাহায্য আসেনি।’
এই আসিফুল ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের বাগানবাড়ি এলাকার সৈয়দ নুরুল ইসলাম ও পারভিন আক্তারের ছেলে। ২০১১ সালে তিনি নাবিক হিসেবে যোগদান করেন।
ছেলে ইউক্রেনে আটকা পড়ার খবরে উদ্বিগ্ন আসিফের পরিবার। তবে বৃহস্পিতবার বিকেল বেলা ৩টার দিকে আসিফের দেয়া ফোনে যেন প্রাণ ফিরে আসে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।
নাবিক আসিফুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে ২ মিনিট কথা বলেছেন আসিফ। মাকে জানিয়েছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে একটি টিম তাদেরকে উদ্ধার করতে আসছে।
আসিফের মা পারভিন আক্তার জানান, ‘আতঙ্কিত ছিলাম। আসিফের ফোনে মন অনেকটাই শান্ত হয়েছে। আমি সরকারের কাছর অনুরোধ করি, আমার ছেলেকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক।
আসিফের বাবা সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বুধবার একটি রকেট ওদের জাহাজে এসে পড়ে। জাহাজটিতে বিস্ফোরণ হয় এবং আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় হাদিসুর রহমান নামে এক প্রকৌশলী নিহত হয়েছেন। আসিফ তখন সেই আঘাতের ১০ ফুট দূরত্বে থাকায় বেঁচে যায়।’
প্রতিবেদনে তথ্যের যোগান দিয়েছেন নিউজবাংলার স্থানীয় প্রতিনিধিরা। তারা হলেন-কামরুজ্জামান মিন্টু (ময়মনসিংহ), জাহিদুজ্জামান (কুষ্টিয়া), মাজহারুল করিম অভি (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ও শামীম আল মামুন (টাঙ্গাইল)।