দুই দেশের যুদ্ধ-দামামার মধ্যে বাংলাদেশের বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের ইউক্রেন যাত্রা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাহাজটি ঝুঁকির মধ্যে কেন পাঠানো হলো, সে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ মেরিন অ্যাকাডেমির ক্যাডেটরা।
বুধবার ইউক্রেনে অলিভিয়া বন্দর চ্যানেলে আটকা পড়া ওই জাহাজে রকেট হামলায় এক নাবিক নিহত হওয়ার পর এসব প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরু হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে। এর আগ থেকেই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এমন পরিস্থিতিতে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজটি ২১ ফেব্রুয়ারি তুর্কির এরেগলি বন্দর ছেড়ে ইউক্রেনের উদ্দেশে যাত্রা করে। ২২ ফেব্রুয়ারি এটি ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে পৌঁছায়।
মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে জাহাজটির ইউক্রেন যাত্রা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন মেরিন ক্যাডেট ও তাদের স্বজনরা। তারা বলছেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে ওয়ারজোনে এ জাহাজ না পাঠালে প্রাণহানি ঘটত না।’
তবে জাহাজটির মালিক বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘চার্টারারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী অ্যাডিশনাল ওয়ার প্রিমিয়াম দিতে সম্মত হলে ওয়ারজোনে জাহাজ পাঠাতে বাধা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
বাংলার সমদ্ধির ২৯ নাবিক-ক্রুর মধ্যে ১৪ জন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও অফিসার বাংলাদেশ মেরিন অ্যাকাডেমির সাবেক ক্যাডেট। অ্যাকাডেমির জুনিয়র ও সিনিয়র মেরিন ক্যাডেটরা বলছেন, ‘ঝুঁকি নিয়ে ইউক্রেনে জাহাজ পাঠানো নিয়ে বিএসসির সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মেরিন ক্যাডেটের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। ক্ষুব্ধ ক্যাডেটরা বলেন, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে ইউক্রেন বন্দরে জাহাজ পাঠানোর বিষয়ে বিএসসি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাদের কাছে ক্যাডেটদের জীবনের চেয়ে বাণিজ্যটাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।’
এদিকে সামাজিক যোগাযাগমাধ্যমে জাহাজে থাকা নাবিক-ক্রুদের প্রাণ বাঁচানোর আকুতি ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে আটকে পড়া নাবিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে অলিভিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে পোল্যান্ড দূতাবাস। জাহাজ পরিত্যাক্ত ঘোষণার পর টাগবোটের মাধ্যমে নাবিক-ক্রুদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদশ শিপিং করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) ড. পীযূষ দত্ত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চার্টারারের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি রয়েছে, সেখানে চার্টারার অ্যাডিশনাল ওয়ার প্রিমিয়াম দিতে সম্মত ছিল। ফলে জাহাজটি না পাঠানোর সুযোগ ছিল না।’
বিএসসির এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন মো. এনাম চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক্সট্রা প্রিমিয়ামের জন্য এভাবে আমাদের নাবিকদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া উচিত হয়নি। বিএসসি চাইলে চার্টারারের এই প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পারত। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে এসব চুক্তি লঙ্ঘন করা যায় অনায়াসেই। এটা মেরিটাইম আইনেই আছে।’
বাংলাদেশ মেরিন অ্যাকাডেমির ৪৯তম ব্যাচের ক্যাডেট আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত নাবিকরা তাদের বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছেন। মেরিন কমিউনিটিও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এর পরও বিএসসি কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। বাংলাদেশের রাশিয়া অ্যাম্বাসির সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে এমন পরিস্থিতি হয়তো হতো না।’
রকেট হামলায় নাবিক নিহতইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে দেশটির অলিভিয়া বন্দর চ্যানেলে আটকে থাকা ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে রকেট হামলায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান নিহত হন।
বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত ৯টা ২৫ মিনিটে যুদ্ধবিমান থেকে রকেট হামলায় বাল্কটির ডেকে আগুন ধরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন জাহাজের ক্রু ও নাবিকরা।
জাহাজটিতে রকেট হামলায় নিহত নাবিক হাদিসুর রহমানের গ্রামের বাড়ি বরগুনার বেতাগীতে।