চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ আগে থেকেই। এবার চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে নিয়োগের বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের চেষ্টার কয়েকটি ফোনালাপের ক্লিপ ফাঁস হয়েছে।
ফোনালাপের তিনটি ক্লিপ নিউজবাংলার হাতে এসেছে। এতে একজন আবেদনকারীর কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা দাবি করা হয়। বলা হয়, তৃতীয় শ্রেণির একটা চাকরির জন্য এখন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা লাগে। মালি, প্রহরীর মতো চতুর্থ শ্রেণির চাকরির জন্য লাগে ৮ লাখ টাকা।
ফাঁস হওয়া ফোনালাপে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের 'ম্যানেজ’ করতেই অর্থের প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়।
চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে যারা কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য শিরীণ আখতারের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মোকাররম হোসেন রবীন, অপরজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টস শাখার কর্মচারী আহমদ হোসেন এবং ফার্সি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী জসীম উদ্দিন বলে তথ্য মিলেছে।
তিনজনের ফোনালাপেই এই লেনদেনে উপাচার্য সম্পৃক্ত থাকবেন বলে দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, উপাচার্য রাজি না থাকলে মন্ত্রী বা আরও বড় কেউ চাকরি দিতে পারবেন না।
তবে রবীন ও আহমদ হোসেন দাবি করেছেন, তারা কারও সঙ্গে এসব কথা বলেননি। এগুলো তাদেরকে বিপদে ফেলার জন্য বানানো হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্যের বক্তব্য পাওয়া যায়নি তিনি ফোন ধরেননি বলে।
তবে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মনিরুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, অডিও ক্লিপটির বিষয়ের পর তারা হাটহাজারী থানায় অভিযোগ করেছেন। উপাচার্যের পিএস পদ থেকে মোকাররম হোসেন রবীনকে প্রত্যাহার করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর আহমদ হোসেনকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
এই নিয়োগ নিয়ে এর আগেও নানা অভিযোগ ছিল। এমনভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে ১০ দিন সময় দেয়া হলেও নিয়োগপ্রার্থীরা কার্যত কেবল এক দিন সময় পেয়েছেন। অনলাইনে আবেদনপত্র ডাউনলোডের সুযোগও দেয়া হয়নি। পরে একজন প্রার্থী উচ্চ আদালতে গেলে তার আবেদনের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বলা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় তা করেনি।
এখানেই শেষ নয়, মৌখিক পরীক্ষার জন্য সবাইকে ভাইভা কার্ড না পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। আবার কার্ড ছাড়াই পরীক্ষা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
আবার নিয়োগ বোর্ডে কোনো ফার্সি বিশেষজ্ঞকে রাখা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, পছন্দের কোনো প্রার্থীকে নিয়োগ দিতেই এতসব করা হচ্ছে।
প্রথম ফোনালাপ
একটি কল রেকর্ডে প্রভাষক পদের আবেদনকারী এক নিয়োগপ্রার্থীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পিএসকে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলতে শোনা যায়।
সেই ফোনালাপে উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল মোকর রবীন পরিচয় দিয়ে নিয়োগপ্রার্থীকে বলেন, ‘আমি ম্যাডামের (উপাচার্য) সঙ্গে দেখা হলে তোমার কথা বলব। ম্যাডাম যেভাবে বলে সেভাবে হবে।’
সেই নিয়োগপ্রার্থী নিজেকে রবীনের (পিএস) শ্বশুরবাড়ির এলাকার বলে উল্লেখ করলে রবীন বলেন, 'আপনি চিটাইংগায়ের (চট্টগ্রামের) দেখেই তো আমি একটু টান দিলাম।’আরও পড়ুন: চবির ফার্সি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এতকিছু!
অর্থিক বিষয়ে ইঙ্গিত করে রবীন বলেন, ‘ঝামেলার বিষয়গুলোতে আমি আসলে যেতে চাই না। প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা হলো এগুলাই হচ্ছে। আমি তোমার ভাবির (রবীনের স্ত্রী) জন্যও চেষ্টা করেছি। কিন্তু গতবার আমি শুধু এটা (টাকা) দেই নাই বলেই হয় নাই (চাকরি)।
‘আমার স্ত্রী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছে। বর্তমানে সে (আমার স্ত্রী) সাউদার্ ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আছে। কিন্তু আমি সেই সুযোগটা পাইনি। আমি যদি এগ্রি (টাকার বিষয়ে সম্মত) করতাম তাহলে এতদিনে হয়ে যেত।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রবীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এগুলোর কিছু আমি জানি না। শুনে পরে কথা বলব এ বিষয়ে।’
‘অর্ধেক নিয়োগের আগে, অর্ধেক পরে’
আরেকটি কথোপকথনে শোনা যায়, একজন নিজেকে অ্যাকাউন্টস অফিসের কর্মচারী আহমদ হোসেন নামে পরিচয় দিয়ে এক চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি অ্যাকাউন্টস শাখার প্রহরী হলেও পিয়নের কাজ করেন।
লবিং করেছেন কি না জানতে চেয়ে ওই নিয়োগপ্রার্থীকে বলা হয়, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো কিছুর মধ্যে লেনদেন ছাড়া কোনো কিছু হয় না। এ জন্য মন্ত্রীর সুপারিশ বলেন বা যার সুপারিশই বলেন, কোনো কিছুই কার্যকর হবে না।’
তিনি বলেন, ‘এখন কথা হলো, আপনাকে যদি ম্যাডামের (উপাচার্য) সঙ্গে বসিয়ে দিই, আর ম্যাডাম যদি রাজি হন- তাহলে আপনাকে অর্ধেক পেমেন্ট (টাকা) আগে দিয়ে ফেলতে হবে। আর বাকি অর্ধেক আপনি অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার পাওয়ার পর দেবেন।’
নিয়োগপ্রার্থী ওই কর্মচারীর কাছে টাকার পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অ্যামাউন্ট হলো ১৬ (লাখ)। তৃতীয় শ্রেণির একটা চাকরির জন্য এখন ১০-১২ লাখ টাকা লাগে। চতুর্থ শ্রেণির- যেমন মালি, প্রহরীর এসব চাকরির জন্য লাগে ৮ লাখ টাকা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলো সর্বোচ্চ সম্মানী পদ। কাজেই এখানে ১৬ লাখের কম দিলে হবে না।’
টাকা কীভাবে নেয়া হবে এই প্রশ্নের জবাবে অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মচারী পরিচয় দেয়া ব্যক্তি বলেন, ‘ম্যাডাম(উপাচার্য) কি সরাসরি (টাকা) নেবেন নাকি? তাছাড়া ম্যাডাম আবার মন্ত্রণালয়ে লাইনঘাট সব ম্যানেজ করবেন। যাই হোক, এটা আমি জানি বলেই আপনাকে জানাচ্ছি। এখন আপনার যদি সম্মতি থাকে তাহলে আমি আলাপ করে দেখতে পারি।
‘ম্যাডাম যদি হ্যাঁ বলেন, তাহলে আপনি অর্ধেক পেমেন্ট করবেন এবং পেমেন্ট যে করছেন সেটার একটা চেক অথবা ডকুমেন্ট দিতে হবে। কিন্তু ম্যাডাম যদি না বলেন, তাহলে মন্ত্রীও যদি ব্যক্তিগতভাবে সুপারিশ করেন কোনো কাজ হবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আহমদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এগুলোর বিষয়ে আমি জানিও না, শুনিও নাই। আমি একজন ছোট চাকরিজীবী।
‘আমার মোবাইল হারিয়ে গেছে অনেক দিন আগে। সেই মোবাইল আমি ব্যবহার করছি না সিমও ব্যবহার করছি না। আমার সিম থেকে কেউ যদি কিছু বলে থাকে সেটা শত্রুতামি করে আমাকে বিপদে ফেলার জন্য করেছে। এগুলা আমি জানি না।’
মোবাইল ফোন হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না জিডি করিনি। জিডি করা লাগে সেটাও আমি জানি না।’
তৃতীয় ফোনালাপে যা শোনা গেল
তৃতীয় অডিও ক্লিপটিতে জসিম উদ্দিন নামের ফার্সি বিভাগের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় ওই নিয়োগপ্রার্থীর।
সেখানে জসিম বলেন, ‘ওয়াক্কাস নামের এক নিয়োগপ্রার্থী রবিন স্যারের কাছে গেছেন। রবিন স্যার আমাকে বলছেন, ম্যাডাম নাকি বলেছেন চট্টগ্রামের দুই একটা ছেলে আছে না? ওরা তো যোগাযোগ করল না।..
‘আমি ওয়াক্কাসকে বলি, রবিন স্যার তোকে কনফার্ম করে দেবে। এখানে টাকা পয়সার একটা ব্যাপার আছে। ওয়াক্কাসকে রবিন স্যার নাকি বলেছে পাঁচ লাখ টাকা দিতে। তবে এখন না। নিয়োগপত্র পাওয়ার পর। এটা কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না।’
ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার যা বললেন
বিশ্ববিদ্যালের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা অনেক আগেই ব্যবস্থা নিয়েছি। হাটহাজারী থানায় এ বিষয়ে আমাদের অভিযোগ দেয়া আছে। এটা তদন্তের মধ্যে আছে।’
তদন্ত কমিটি হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি আমাদের পক্ষ থেকে এখনও হয় নাই, হচ্ছে।’
অভিযুক্তদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা নিয়ে তদন্ত চলছে। এরপর আমরা আমাদের মতো ব্যবস্থা নেব।’