একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মনোয়ারা বেগম সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন তিনি। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে ফিরলেও মনোয়ারার কপালে এখনও জোটেনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি।
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের বাদলা গ্রামে মনোয়ারার জন্ম। সেদিনের কিশোরী মনোয়ারা বয়সের ভারে আজ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। ঠিকমতো খেতে পান না। শহরের অম্বিকাপুরের একটি ভাঙা ঘরে তার বাস। স্বামীর পেনশনের টাকা, নিজে রঙিন কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করে বিক্রির টাকায় কোনো রকম দিন পার করছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাবা হিসেবে জানেন মনোয়ারা। এই বঙ্গবন্ধুই নির্যাতিত নারীদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই স্বীকৃতি না পেলেও ক্ষোভ নেই তার। শেষ বয়সে কারো করুণা চান না তিনি।
তবে একটি স্বপ্ন আছে মনোয়ারার। তিন বছর ধরে নিজের হাতে সুঁই-সুতো দিয়ে বোনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি শিল্পকর্ম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিতে চান তিনি। এটিই তার শেষ চাওয়া।
পাকিস্তানি মিলিটারির নির্যাতন
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মনোয়ারা। বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এক দিন পাকিস্তানি মিলিটারিরা আমাদের গ্রামে ঢুকে আগুন দেয়। চারদিকে আগুন দেখে নানি আমাকে পালিয়ে যেতে বললেন। একটা বড় গাছের পেছনে লুকাই আমি। একপর্যায়ে গাছের গোড়ায় শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর এক মিলিটারি আমার চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যায়।
‘সেখানে আরও কয়েকজন অপরিচিত মেয়ে দেখি। এরপর শুরু হলো নির্যাতন। প্রতি রাতে আমাদের নিয়ে যেত বিভিন্ন ক্যাম্পে। সেখানে পাকিস্তানি আার্মিরা গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের নানা ধরনের অত্যাচার করত। এমনকি ৪ থেকে ৫ জন মিলেও অত্যাচার করতো আমাদের।’
তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ হলেও ওদের হাত থেকে রেহাই পাইনি। ঠিকমতো খাবার দিত না। কেউ যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে, সেজন্য শাড়ি ও ওড়না পরতে দিত না আমাদের। চোখের সামনে অনেক মেয়ের মৃত্যু দেখেছি। প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর শঙ্কায় থাকতাম। এক দিন দেখি মিলিটারিরা নেই। বাইরে হট্টগোল। আমাদের বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। আমার যৌনাঙ্গে অপারেশন করতে হয়েছিল।’
মনোয়ারা জানান, বাড়ি ফিরে গেলেও কেউ তাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেয়নি। তার বাবা বাড়ির সামনে থেকেই তাড়িয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ‘অজানা পথে চলতে গিয়ে একজন পথচারী আশ্রয়ের কথা বলে আমাকে নিয়ে গিয়ে বাগেরহাটের পতিতালয়ে বিক্রি করে দেন। সেখানে বছর খানেক পর আরেকজন খুলনার ফুলতলা ও সবশেষে আরেকজনের হাত ঘুরে ফরিদপুরের যৌনপল্লিতে ঠাঁই হলো। সেখানে এক পুলিশের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। সেই ঘরে আমার এক মেয়ে হয়।’
মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘পাকবাহিনীর ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরব ভাবিনি। সে দিনের পর থেকে বাবা বলতে বঙ্গবন্ধুকেই মনেপ্রাণে ধারণ করে আসছি। প্রায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে কাপড়ের ওপর সুই-সুতো দিয়ে বাবার (বঙ্গবন্ধু) একটি ছবি বুনেছি। এ ছবি প্রতিটি সুই-সুতোর ফোঁড়ের সঙ্গে আমার জীবনের গল্প-স্মৃতি জড়িয়ে আছে। নিজের হাতে বোনা এ শিল্পকর্মটি বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়ে মরতে চাই।’
মনোয়ারা বেগমের নাতি কামরুজ্জামান সুমন বলেন, ‘আমি নানির খোঁজ-খবর রাখি। তার স্বীকৃতির জন্য ফরিদপুর ও বরিশাল থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনেক ঘুরেছি কিন্তু ফল হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নানির শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। তার শেষ ইচ্ছা নিজের হাতে বোনা বঙ্গবন্ধুর শিল্পকর্মটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেয়া।’
এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদ্য সাবেক কমান্ডার আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ বলেন, ‘উনার বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি বিষয়ে কোনো দালিলিক প্রমাণপত্র নেই। আবার উনার ঘটনাস্থল বরিশালে। তারপরও আমাদের পক্ষ থেকে মনোয়ারার বিষয়টি নিয়ে ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইউএনওকে সুপারিশ করেছেন।’
আবুল ফয়েজ বলেন, ‘মনোয়ারা বেগমের শেষ ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। এটি প্রশাসনের বিষয়। সেক্ষেত্রে আমাদের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমরা উনার পাশে থাকব।’
ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদুল আলম বলেন, ‘ঘটনাস্থল বরিশালের বাবুগঞ্জ। তারপরও বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগের পর আমি একটি প্রতিবেদন বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠাই। আমার পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের সহযোগিতার চেষ্টা করব।’