বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সরকারের ‘না’র পর সরবরাহে টান, বেড়েছে দাম

  •    
  • ১ মার্চ, ২০২২ ২৩:১৮

ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা ১ মার্চ থেকে লিটারে সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, রোজার আগে দাম বাড়বে না। তিনি আন্তর্জাতিক বাজারের বাড়তি দামের উত্তাপ সহ্য করতে ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেন। মন্ত্রীর এই বক্তব্যে ভোক্তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি এলেও বাজারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়।

মাস খানেক পরই রমজান। তার আগেই বাজারে শুরু হয়ে গেছে ভোজ্যতেলের ভূতুরে সংকট। দাম বাড়ানোর অনুমতি না পেয়ে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা ঠিকই ভোক্তাদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করছে।

খুচরা বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাহিদামতো তেল পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, মিল থেকে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।

মিল মালিকরা এই অভিযোগ স্বীকার না করলেও তেলের দামের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বুকিং কমিয়ে দেয়ার কথা জানাচ্ছেন।

এই পরিস্থিতিতে তেল ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী নেতাদেরকে মন্ত্রণালয়ে ডেকেছে সরকার। তেলের মজুত নিয়ে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানোর কথা বলছেন সরকারি কর্মকর্তারা। বলছেন, কারসাজির প্রমাণ মিললে মজুত জব্দ হবে, নেয়া হবে আইনি ব্যবস্থা।

ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা ১ মার্চ থেকে লিটারে সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, রোজার আগে দাম বাড়বে না। তিনি আন্তর্জাতিক বাজারের বাড়তি দামের উত্তাপ সহ্য করতে ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেন।

মন্ত্রীর এই বক্তব্যে ভোক্তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি এলেও বাজারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়।

বাণিজ্যমন্ত্রী না করলেও বেড়ে গেছে দাম

রাজধানীর কাওরান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, সেগুনবাগিচা ও রামপুরা বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, গত তিন-চার দিনে খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ২০ টাকা বেড়েছে এবং প্রতি লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ১৯৫ থেকে ২০০ টাকায়। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দামও আগের চেয়ে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা থেকে ১৮০ টাকায় উঠেছে। দোকানিরা আগে সংরক্ষিত তেলও চড়া দামে বিক্রি করছেন।

অর্থাৎ সরকার সয়াবিন তেলের বাড়তি দরের বিষয়টি অনুমোদন না করলেও ভোক্তাদেরকে ঠিকই তা পরিশোধ করতে হচ্ছে।

সরবরাহের ঘাটতি

খুচরা বিক্রেতারা দাবি করছেন, চাহিদা অনুযায়ী তারা তেল পাচ্ছেন না। ১০ ড্রাম চাইল মিলছে দুই ড্রাম। পাইকাররা বলছেন, ৫০ ড্রামের জায়গায় পাচ্ছেন ২০ ড্রাম।

পরিবেশকরা বলছেন, মিলগুলো সাপ্লাই দিচ্ছে না। আবার মিলাররা বলছেন, মিলগটে কোনো গাড়ি অপেক্ষমান নেই, সব ডিও তারা সময়মত সরবরাহ দিচ্ছেন। কোনো গাড়িই তেল ভর্তি ছাড়া খালি ফিরছে না। অপরদিকে ক্রেতারা তেল কিনতে গেলেই গুনতে হচ্ছে বাড়তি দাম।

রামপুরা কাঁচাবাজারের মুদি দোকানি মফিজুল হক বলেন, ‘পাইকারি বাজারে কোনো ভোজ্যতেল পাওয়া যায় না; বোতলজাত তেলের সরবরাহও বন্ধ। তাই দাম বাড়ছে।’

সেগুনবাগিচা কিচেন মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, অর্ডার দিয়েও তারা সময় মতো তেল পাচ্ছেন না।

শান্তিনগরের কাঁচাবাজারের পাইকারি বিক্রেতা মো. হুমায়ুন বলেন, ‘সব কোম্পানি গত কয়েকদিন ধরে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা ক্রেতাদের কিছু ব্যাখ্যা করতে পারি না এবং সরবরাহ কেন বিঘ্নিত হচ্ছে তার কারণও বুঝতে পারি না।’

সোনালী ট্রেডার্সের মালিক ও ভোজ্যতেলের পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল কাশেম বলেন, ‘কোম্পানিগুলো নতুন অর্ডার নিচ্ছে না এবং পণ্য ডেলিভারিও করছে না। যার কারণে বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে মিলের গেটে কোনো তেল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন দোকানে সংরক্ষিত তেলও ফুরিয়ে যাচ্ছে।’

স্বীকার করছেন না সরবরাহকারীরা

বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকটের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করেননি বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অব্যাহতভাবে বিক্রি করে যাচ্ছি। ডেলিভারি পাচ্ছে আমাদের ডিলাররা। যা ডিও আসতেছে, যে কয়টি গাড়ি আসছে তার সবই তেল ভর্তি যাচ্ছে।’

তবে ভোজ্যতেলের বাজার যে স্বাভাবিক নয়, সেটি তার কথায় উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘বাজার তো এখন চড়া। কখন কী হয় এমন একটা আশঙ্কা তো আছেই। এ কারণে কার কী অবস্থা সেটি বলতে পারব না, আমি আমাদের কথা বলতে পারি, নতুন বুকিং দেয়ার সাহস হচ্ছে না। আবার এটাও সত্য, আগের মতো খুব যে মাল বুক করেছি তা-ও না। একটু সাবধানে করছি।’

সরবরাহ সংকট প্রসঙ্গে সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা নিউজবাংলাকে জানান, অভ্যন্তরীণ বাজারে তীর ব্যান্ডের সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে।

বৈঠক ডেকেছে সরকার

ভোজ্যতেল নিয়ে এই পরিস্থিতিতে সরকার ব্যবসায়ীদেরকে বৈঠকে ডেকেছে।

বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে হতে যাওয়া সেই বৈঠকে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ছাড়াও এফবিসিসিআই, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা শাখার সদস্য, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের আসতে বলা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকে ভোজ্যতেলসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের চাহিদা নিরূপণ, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, আমদানির পরিমাণ, মজুদ পর্যালোচনা করা হবে।

এছাড়া গত দুই মাসে কারা কোন পণ্যের কী পরিমাণ এলসি খোলেছে, কী পরিমাণ বন্দরে প্রবেশ করেছে এবং কতটা নিষ্পত্তি হয়েছে, তার কতটা বাজারে প্রবেশ করেছে তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হবে।

বৈঠকের পর বাজার মনিটরিং জোরদারের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্য করে অভিযান চালানো হবে।

আমরা কঠোর হব: অতিরিক্ত সচিব

বাজারে এ ধরনের ভূতুরে পরিস্থিতির নেপথ্যে কারা রয়েছে -তা বের করতে এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার। এজন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মজুত, সরবরাহ ও বিক্রির সংগ্রহকৃত নথি ও রেকর্ড খতিয়ে দেখার পর অভিযুক্ত মিলার, ডিলার, পাইকার কিংবা খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহ থাকা ভোজ্যতেল জব্দ করার কথাও ভাবা হচ্ছে। নেয়া হতে পারে আরও কঠোর পদক্ষেপও।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আমদানি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরবরাহ চেইনে সমস্যা কোথায়? মিলার না, ডিলার? পাইকাররা না খুচরা বিক্রেতা? এখন তো একজন আরেকজনের কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছে, এখন আর সেই কথা বলার সময় নেই। খুব শিগগির আমরা অ্যাকশনে যাচ্ছি।

‘বাস্তবে সাপ্লাই চেইনে কারা কী সমস্যা করছে, তা খুঁজে বের করা হবে। এ কারণে বুধবার সব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ন্ত্রক এজেন্সিগুলোকে ডাকা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা মিলার বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শেষ দুই মজুত রেকর্ড চেক করব। এর থেকে তারা কবে কী পরিমাণ বাজারে ছেড়েছে, আগে কেন ছেড়েছে-এখন কেন ছাড়ছে না তা খতিয়ে দেখব। কারা কোথায় কী ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে, কাদের মজুতে কী পরিমাণ তেল রয়েছে বের করা হবে। আমরা এখন হার্ডলাইনে রয়েছি। দোষী প্রমাণিত হলে দায়ী সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা সিজ করে ফেলব।’

তেলের দাম বাড়ানোর চেষ্টা

সবশেষ ৬ ফেব্রুয়ারি সরকার বোতলজাত সয়াবিন তেলের খুচরা মূল্য লিটার প্রতি ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা করে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৩ টাকা এবং পাম তেলের লিটার প্রতি ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দাম এখন কেউ মানছে না।

উল্টো আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে, বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনারস অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন গত রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে প্রতিলিটার ভোজ্যতেলের দাম আরও ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। তারা বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৮০ টাকা নির্ধারণ করার কথা জানায়।

নতুন দাম মার্চের প্রথম দিন থেকেই থেকেই কার্যকর করার কথা জানানো হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা না করেই।

তবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, তারা তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে না করে দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক বাজার লাগামহীন

অয়েল ওয়ার্ল্ড, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মতে, এ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম গত বছরের তুলনায় ৩৩.৪৬ শতাংশ এবং ৩৪.৯০ শতাংশ বেড়েছে।

দেশের বাজারেও সয়াবিন তেলের দাম এক বছরে প্রায় সমপরিমাণ বেড়েছে।

ব্যবসায়ীরা দাবি করছে, সবশেষ যখন দাম বাড়ানো হয়, সেই তেল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনা হয়েছে, এখন দাম অনেক বেশি।

কোন যুক্তিতে দাম বাড়াতে চাইছেন- জানতে চাইলে দেশে ভোজ্যতেল বিপণনে সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লিটারে ১৬৮ টাকায় যে তেল আমরা বিক্রি করছি, সেটির আন্তর্জাতিক বাজার ছিল টনপ্রতি এক হাজার ৩০০ ডলার। এখন যে তেল আমরা বাজারে ছাড়তে যাচ্ছি, সেটি এক হাজার ৪২০ ডলারের। আগামী এক থেকে দেড় মাস পর আন্তর্জাতিক বাজারে কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটি আমরা এখনই বলতে পারছি না। কিন্তু এক হাজার ৭০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস আছে। তখন পরিস্থিতি কী হবে, তা জানি না।’

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেল বর্তমানে ১ হাজার ৫১৫ ডলারে বিক্রি হচ্ছে, যা কয়েক মাস আগেও আগে ছিল ১ হাজার ১২৩ ডলার। পামওয়েলের দর ১ হাজার ১৯ ডলার থেকে ১ হাজার ৩৬০ ডলার হয়েছে।

২০২১ সালে বিশ্ব বাজারে সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ দাম ১ হাজার ৫৬৮ ডলার উঠেছিল।

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের বড় সরবরাহকারী দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশটি এখন পাম তেল রপ্তানিতে সংরক্ষণ নীতি অনুসরণ করছে। তারা নিজ দেশের নাগরিক ভোক্তাদের সুরক্ষায় চাহিদার ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত রিজার্ভ রাখছে। ফলে তেলের বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনেও বিলম্ব হচ্ছে। এসবের প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারেও।

এ বিভাগের আরো খবর