চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে মৃতদেহের সঙ্গে যৌনাচারে যার নাম এসেছে সেই সেলিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ বলছে, একটি ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি এর আগে দুই বছর জেলও খেটেছেন। মাদকাসক্ত সেলিম নানাভাবে হয়রানি করতেন স্বজনহারা মানুষদের।
এসব অভিযোগ নিয়ে ১৫ বছর ধরে সেলিম মর্গে লাশ আনা-নেয়া ও পাহারার কাজ চালিয়ে গেছেন। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তিনি বহিরাগত ও ধূর্ত।
সেলিম কুমিল্লার লাকসাম থানার সাতেশ্বর এলাকার বাসিন্দা। চট্টগ্রামে তার বসবাস বহাদ্দার হাট এলাকায়। সোমবার নারী ও শিশুর মৃতদেহের সঙ্গে যৌনাচারের অভিযোগে তাকে আটক করে পুলিশ। এদিন রাতে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে তাকে রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন সিআইডির উপপরিদর্শক কৃষ্ণ কমল বণিক। তিনি বলেন, ‘তদন্ত করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি ৪৮ বছর বয়সী সেলিম তিন বিয়ে করলেও তাদের কারও সঙ্গেই তার যোগাযোগ নেই। চারিত্রিক কারণে পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে থাকেন না। হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে আপত্তিকর আচরণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একই কথা বলেছেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের একজন বলেন, ‘সেলিমের স্বভাব চরিত্র ভালো ছিল না। জরুরি বিভাগে আসা রোগীর স্বজন ও নারী কর্মচারীদের সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করতেন। তাদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে টাকা নিতেন সেলিম।’
অর্পণ চক্রবর্তী নামে রোগীর এক স্বজনের কথায় এই অভিযোগের সত্যতা মেলে। তিনি বলেন, ‘‘গত মাসে আমার এক ফুফুর মরদেহ কিছু সময়ের জন্য লাশঘরে রাখা হয়। ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে রাত হয়ে যায়। পরে লাশ নিতে গেলে ১০০০ টাকা দাবি করেন এই সেলিম। কিছু টাকা কম রাখতে বললে, ওই ব্যক্তি গালিগালাজ করেন এবং লাশ দেবেন না বলেও হুমকি দেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসনকে খাই না’। পরে ৫০০ টাকা দিয়ে, বুঝিয়ে শুনিয়ে লাশ নিয়ে আসি।’’
২০১৭ সালে সেলিমের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় একটি ধর্ষণ মামলা হয়। এ মামলায় একাধিকবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে। জেলে থেকে বেরিয়ে ফের লাশ ঘরে দেখা যেত তাকে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পাঁচ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক আলাউদ্দিন তালুকদার। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানে দায়িত্ব পালনের শুরু থেকেই লাশ ঘরের সহকারী হিসেবে সেলিমকে চিনতাম। কর্মচারী না হলেও লাশ পাহারা ও স্ট্রেচার মর্গে নিয়ে যাওয়ার কাজ করতেন তিনি।’
পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদিকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ধর্ষণে সহযোগিতা করার অভিযোগে ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হন সেলিম। এর পর দুই বছর জেল খাটেন। তার পর জামিনে ছাড়া পান।
‘প্রচুর নেশা করেন সেলিম। হাসপাতালের কোনো কর্মচারী না হয়েও তিনি কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে লাশ ঘরে কাজ করছেন তা নিয়ে আমরা অনুসন্ধান করছি।’
এ বিষয়ে জানতে নিউজবাংলা মুখোমুখি হয় হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সেলিম বহিরাগত। জরুরি বিভাগের সামনে তার মতো অনেকেই সারাদিন ঘোরাফেরা করেন। মাঝে মধ্যে তারা নিজেদের রোগীর স্বজন বলেও পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাই সবসময় তাদের ধরা সম্ভব হয় না।
‘রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নেশা করাই তাদের মূল কাজ। বর্তমানে হাসপাতালে এমন দুই থেকে আড়াই হাজার লোক রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে।’
যেভাবে সামলে এলো মরদেহের সঙ্গে সেলিমের যৌনাচার
সিআইডির উপপরিদর্শক কৃষ্ণ কমল বণিক ঘটনার আদ্যোপান্ত জানান। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে এক নারীর ও ২৫ এপ্রিল এক শিশুর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পাঠানো হয়। হাসপাতালের ১ নম্বর ইমার্জেন্সি মর্গে মরদেহ দুটি রাখা ছিল।
‘মৃত্যুর আগে ধর্ষণ হয়েছিল কি না জানতে মরদেহ দুটির আলামত ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়। দুটিতে একই বীর্যের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে মরদেহে বলপ্রয়োগ বা কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না।’
কৃষ্ণ কমল বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দেয়। মর্গে লাশ পাহারা দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন সেলিম। তাকে সন্দেহ হওয়ায় অফিসে চা খাওয়ার দাওয়াত দিই। এরপর কাপে লেগে থাকা লালা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করি। মরদেহ দুটিতে পাওয়া শুক্রাণুর ডিএনএর সঙ্গে সেলিমেরটির মিলে যায়।’