মহামারি করোনার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য। প্রতি মাসেই বাড়ছিল আয়। বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন রপ্তানিকারকরা। প্রত্যাশা করা হচ্ছিল চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন (৫ হাজার কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
সাড়ে তিন মাসের উত্তেজনার পর বৃহস্পতিবার সত্যি সত্যি ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে রাশিয়া।
ইউক্রেনে রুশ হামলায় নিহত একজনের মরদেহ কার্পেট দিয়ে ঢাকছেন এক ব্যক্তি। ছবি: এএফপি
এর জবাবে রাশিয়ার ব্যক্তি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমা মিত্ররা।
বাল্টিক অঞ্চলের যে সমুদ্রপথ ধরে রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশি পণ্যগুলো এতদিন রপ্তানি হচ্ছিল, সেসব এলাকাতেও ছড়িয়েছে যুদ্ধের উত্তেজনা। ফলে সেসব এলাকার চলমান রপ্তানি আদেশ এবং ভবিষ্যতের ক্রয়াদেশ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগে পড়ার কথা বলেছেন তৈরি পোশাক খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। প্রতি মাসেই ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের দেশগুলোর পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেনের মতো নতুন বাজারেও আমাদের রপ্তানি বাড়ছিল, কিন্তু এই যুদ্ধ সবকিছু কেমন জানি ওলটপালট করে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ যে কেবল বাজার অস্থিতিশীল করছে, তা নয়, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাতে জাহাজ ভাড়া আরও বেড়ে যেতে পারে। এমনিতেই জাহাজ ভাড়া বাড়ায় আমদানি-রপ্তানি খাত ধুঁকছে।’
ইআরএফ সংলাপে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। ফাইল ছবি
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ৬৫ কোটি ডলার এবং অন্যান্য দেশের মাধ্যমে আরও ২০ থেকে ৩০ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য রাশিয়ায় রপ্তানি হয়।
‘এই যুদ্ধ আমাদের অনেক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া ইউরোপের কাছাকাছি দেশ হওয়ায় এই যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।’
নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির একটা বড় বাজার হয়ে উঠছিল রাশিয়া। ইউক্রেনের সঙ্গে দেশটি যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে পোশাক রপ্তানিকারকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।’
তিনি বলেন, “রাশিয়ার হয়ে যারা আমাদের কাছ থেকে পোশাক কেনেন, তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তাদেরও কিছু করার নেই। ক্রেতারা এই পরিস্থিতিতে ‘একটু অপেক্ষা করতে’ বলছেন। কিন্তু পোশাক প্রস্তুতের পর তা নিয়ে অপেক্ষা করা কঠিন। কারণ এখানে ব্যাংকের দায়সহ নানা বিষয় জড়িত।”
হাতেম আরও বলেন, ‘বুঝতে পারছি না, কতদিন চলবে এই যুদ্ধ। শেষ পরিণতি কী কবে। কতটা ক্ষতি হবে আমাদের। খুব চিন্তায় আছি।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। তার মধ্যে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৫৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক, দেশীয় মুদ্রায় যা ৫ হাজার ৭৪ কোটি টাকার সমান। অন্যদিকে ইউক্রেনে রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ ডলারের বা ১০০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। ফাইল ছবি
পোশাক শিল্পের তরুণ উদ্যোক্তাদের সংগঠন বায়লার সভাপতি আবরার হোসেন সায়েম বলেন, ‘যুদ্ধ কখনোই সুসংবাদ নয়। ইতিমধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এতে তৈরি পোশাকসহ সব ধরনের পণ্যের ওপরই কম-বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে রুশ হামলায় আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ যুদ্ধ যদি আশপাশের দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে রপ্তানি ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ ইউক্রেনের পাশেই জার্মানি ও পোল্যান্ডের মতো বড় বাজার।’
সিএনএনের খবরে বলা হয়, স্থল ও সমুদ্রপথে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ইউক্রেনের বন্দরগুলোর কার্যক্রম স্থগিত করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শস্য ও তেলবীজের রপ্তানিকারক দেশটি থেকে পণ্য সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
এর আগে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যবর্তী আজভ সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত স্থগিত করে রাশিয়া।
করোনার প্রভাব কাটিয়ে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ২ হাজার ৩৯৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। এই ধারাবাহিকতায় রাশিয়াতেও রপ্তানি বাড়ছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশটিতে ৪১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
অন্যদিকে ইউক্রেনের বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ৭৯ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৬৪ লাখ ডলারের পোশাক।
তৈরি পোশাক ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় প্লাস্টিক, চামড়া, জুতা, সিরামিক, খেলনা, ম্যাট্রেস, হিমায়িত খাদ্য, পাট ইত্যাদি রপ্তানি হয়। আর ইউক্রেনে পোশাকের বাইরে ওষুধ, প্লাস্টিক, জুতা, ম্যাট্রেস, খেলনাসহ বিভিন্ন পণ্য যায়।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়ার তৈরি পোশাকের বাজার প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের। এই বাজারে আমাদের হিস্যা বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সেটি কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হবে।’