রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকায় বইয়ের মার্কেট বহু পুরোনো। বইপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই মার্কেটে গত মঙ্গলবার রাতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় অন্তত ৫০টি দোকান। আগুনের কারণে ১০ কোটি টাকার ক্ষতির দাবি করছেন বই ব্যবসায়ীরা।
নীলক্ষেতে কীভাবে এই আগুন লাগল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। ফেসবুকে কারও কারও সন্দেহ, বই ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে বহুতল বিপণি বিতান তৈরির জন্য পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হতে পারে।
নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানে আগুনের কারণ অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই বইয়ের দোকানের মালিক-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলেছেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক। এ ছাড়া মার্কেটের অন্য ব্যবসায়ী ও সমিতির নেতাদেরও বক্তব্যও নেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, নীলক্ষেতের যে হযরত শাহজালাল বই মার্কেটে আগুন লাগে, সেখানকার সবাই একে ‘দুর্ঘটনা’ বলে মনে করছেন।
নীলক্ষেতে পুড়ে যাওয়া বইয়ের ফাঁকে অক্ষত কোনোটা পাওয়া যায় কি না, তার সন্ধান করছেন ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। ছবি: সাইফুল ইসলাম/নিউজবাংলা
মার্কেটে যে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তার উদ্যোক্তা স্থানীয় বই ব্যবসায়ীরাই। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ছয় তলা ভবনে সব দোকানই থাকবে বইয়ের। রাজউক থেকে দুই বছর আগে পরিকল্পনা পাস হলেও নানা টানাপোড়েনে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কাজ শুরুর আশা দেখছে না ব্যবসায়ীদের সমিতি।
শাহজালাল বই মার্কেটের পাশের ইসলামিয়া ও বাবুপুরা নামে অন্য দুটি বই মার্কেটে রয়েছে জমি সংক্রান্ত জটিলতা। তাই সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা এ মুহূর্তে নেই।
শাহজালাল বই মার্কেটে যেভাবে আগুন
নীলক্ষেত মোড়ে নিউমার্কেটের বিপরীত দিকেই হযরত শাহজালাল বই মার্কেটের অবস্থান। এই মার্কেটেই মঙ্গলবার আগুনে বিপুল ক্ষতি হয়। এর ঠিক পেছনেই রয়েছে ইসলামিয়া ও বাবুপুরা বইয়ের মার্কেট।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, শাহজালাল মার্কেটের অধিকাংশ দোকান পুড়িয়ে আগুনের আঁচ পৌঁছেছিল ইসলামিয়া বই মার্কেটেও।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করা বেশ কয়েকজন নিউবাংলাকে জানান, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল শাহজালাল মার্কেটের ‘চৌধুরী ফ্রেন্ডস বুক কর্নার’ নামের দোকান থেকে। সেখান থেকে আগুন দ্রুত আশপাশের দোকানে ছড়িয়ে পড়ে।
চৌধুরী ফ্রেন্ডস বুক কর্নার দোকানের পাশের দোকানের মালিক রিয়াজুল ইসলাম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মঙ্গলবার আমাদের সাপ্তাহিক বন্ধ, কিন্তু করোনার কারণে আমরা অনেকে দোকান খোলা রাখি।’
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে রিয়াজুল বলেন, ‘সেদিন চৌধুরী ফ্রেন্ডস বুক কর্নার দোকানের দোতলার গোডাউনে লোহার র্যাক ঝালাইয়ের কাজ চলছিল। সেখান থেকেই ফুলকি ছিটকে বইয়ে আগুন ধরে যায়।’
ইসলামিয়া মার্কেটের একটি দোকানের কর্মচারী রাকিউদ্দিন সে সময় ফ্রেন্ডস বুক কর্নারের গলি ধরে মার্কেটের বাইরে যাচ্ছিলেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি হেঁটে যাওয়ার সময় শুনি ওই দোকানের উপর থেকে কেউ চিল্লায় চিল্লায় বলতেছে, কাটআউট খোল তাড়াতাড়ি। এর মধ্যেই আগুনে সব সাদা হয়ে গেল।’
চৌধুরী ফ্রেন্ডস বুক কর্নারের মালিক ও কর্মচারীরাও দোকানে মেরামতের কাজ চলার তথ্য স্বীকার করেন, তবে তাদের দাবি, ওয়েল্ডিং থেকে আগুন ছড়ায়নি।
দোকানে সে সময় উপস্থিত কর্মচারী জাভেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দোতলার র্যাকে ওয়েল্ডিং করা হচ্ছিল, কিন্তু ওখান থেকে আগুন ধরে নাই। এই মার্কেটের সব দোকানের উপরেই বই রাখার লোহার র্যাক আছে, সব দোকানেই ওয়েল্ডিং করা হয়। তাইলে তো সবসময়ই আগুন ধরত।’
জাভেদের দাবি, আগুন মার্কেটের বাইরের বৈদ্যুতিক তারে শর্ট সার্কিট থেকে লেগেছে।
নীলক্ষেতে পুড়ে যাওয়া বই সরাচ্ছেন দোকানমালিক ও কর্মচারীরা। ছবি: সাইফুল ইসলাম/নিউজবাংলা
চৌধুরী ফ্রেন্ডস বুক কর্নারের মালিকের ছেলে শফিকুর আলম চৌধুরীও দাবি করেন, আগুন তাদের দোকান থেকে লাগেনি।
তিনি বলেন, ‘এটা ভুল কথা। যারা এই কথা বলছেন যে, আমাদের দোকান থেকে আগুন লেগেছে, তারা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলছেন। এমন হলে তো আমার দোকানে যারা কাজ করছিল, তারা পুড়ে মারা যেত।’
আগুনের কারণ নিয়ে মার্কেট সংশ্লিষ্টরা দুটি তথ্য দিলেও তাদের কেউ মনে করছেন না, ঘটনাটি কোনো ধরনের নাশকতা।
শাহজালাল মার্কেট সমবায় সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন রাজু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মার্কেটে আগুন লাগার বিষয়টি একটি নিছক দুর্ঘটনা। এখানে ষড়যন্ত্রের কিছু নেই, তবু তদন্ত করে দেখা হবে এখানে কারও কোনো গাফিলতি আছে কি না। পাশাপাশি চৌধুরী ফ্রেন্ডস বুক কর্নারের মালিকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। তারা জানাবে এ ঘটনায় তাদের কোনো দায় আছে কি না।’
শাহজালাল বই মার্কেটে হবে ৬ তলা ভবন
হযরত শাহজালাল বই মার্কেটটি নীলক্ষেতের সবচেয়ে পুরোনো বইয়ের মার্কেট। ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে তিন শতাংশ জায়গা ৯৯ বছরের লিজ নিয়ে গড়ে তোলা হয় এটি। ২৭ জন সদস্যের শাহজালাল মার্কেট সমবায় সমিতি লিমিটেডের অধীনে পরিচালনা হয় কার্যক্রম।
এখানে ছয় তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা দুই বছর হলো রাজউক থেকে পাস করান সমিতির সদস্যরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, পুরো ভবনেই থাকবে বইয়ের দোকান।
শাহজালাল মার্কেট সমবায় সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন রাজু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছয় তলা বিল্ডিং করব। সেখানে প্রতি তলায় ১০টি করে মোট ৬০টি বইয়ের দোকান থাকবে।
‘প্রতি সদস্য দুটি করে দোকান পাবেন। আর বাকি দোকানগুলো সমিতির থাকবে। সমিতির নামে থাকা দোকাগুলো ভাড়া দিয়ে ভবনের আনুষঙ্গিক খরচ বহন করা হবে।’
ভবন নির্মাণ কবে শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সহসাই হবে না। আমার ধারণা, আরও ৫-৬ বছর তো লাগবেই।’
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সমিতির সদস্যরা বিনিয়োগ নিয়ে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। তাই প্ল্যান পাস করা হলেও এখনই ভবন নির্মাণ সম্ভব নয়। কত দিনে সবাই একমত হবেন, কত দিনে টাকার জোগান হবে, তার ওপরে নির্ভর করছে নির্মাণকাজ। সবাই যত দিন এক না হবেন, তত দিন ভবন নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই।’
মার্কেটের পরিচালক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটা মার্কেট উন্নয়ন কমিটি করেছি। এই কমিটি খরচের বিষয়টি নির্ধারণের জন্য। ছয় তলা মার্কেট করতে কত খরচ হবে, সদস্যদের মাথাপিছু কত দিতে হবে, সেগুলো ঠিক করে সবার সুবিধামতো সময়ে আমরা ভবনের কাজে হাত দেব।’
বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে সদস্যদের মতভেদের পাশাপাশি, অগ্নিদুর্ঘটনার পর ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া আরও পিছিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীদের অনেকে।
নীলক্ষেতে পুড়ে যাওয়া বইয়ের ফাঁকে অক্ষত কোনোটা পাওয়া যায় কি না, তার সন্ধান করছেন ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। ছবি: সাইফুল ইসলাম/নিউজবাংলা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে জানান, নীলক্ষেতের বই মার্কেটের সবচেয়ে পুরোনো এই শাহজালাল সমবায় সমিতির শুরু করেছিলেন নূর আলম চৌধুরীসহ কয়েকজন বই ব্যবসায়ী। তাদের অনেকেই মারা গেছেন। আর নূর আলম চৌধুরী বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। মার্কেটটি নির্মাণে নূর আলম চৌধুরীর অনেক অবদান রয়েছে।
ওই ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য সমিতিতে অনেকবার আলোচনা হয়েছে। প্রত্যেকবারই বিনিয়োগের সামর্থ্য না থাকার কথা বলে অনেক সদস্য পিছিয়ে গেছেন। এখন আগুন লেগেছে নূর চৌধুরীর ফ্রেন্ডস বুক কর্নারে। ফলে অনেকে কানাঘুষা করছেন আগুন ইচ্ছে করে লাগানো হয়েছে।
‘এতে নূর চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা খুব কষ্ট পেয়েছেন। তারা এখন বলছেন, বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য তারা আর সক্রিয় থাকবেন না। সামনে যা যা করার তা সমিতির সদস্যদেরই করতে হবে। ফলে ভবন নির্মাণ থমকে যাওয়ার হুমকিতে পড়েছে।’
নীলক্ষেতের অন্য দুই বই মার্কেটেও জটিলতা
নীলক্ষেত বই মার্কেটের পুরো জমির মালিক সরকার। এর দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন এই খাস জমি বই মার্কেটের জন্য লিজ দিয়েছে।
পুরো নীলক্ষেত বই মার্কেটে রয়েছে ব্যবসায়ীদের তিনটি সমিতি। এর মধ্যে হযরত শাহজালাল মার্কেট সমবায় সমিতি লিমিটেড যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে জমির লিজ পেলেও অন্য দুটি সমিতি আবেদনের পর এখনও লিজ বুঝে পায়নি।
শাহজালাল মার্কেট সমবায় সমিতি লিজ পেয়েছে ৩ শতাংশ জমি। অন্যদিকে ইসলামিয়া মার্কেট বণিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড ৫৮ শতাংশ ও বাবুপুরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড ১৬ শতাংশ জমি দখলে রাখলেও মামলা জটিলতায় লিজের প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি।
ইসলামিয়া মার্কেট বণিক বহুমুখী সমবায় সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইসলামিয়া ও বাবুপুরা সমিতি আগে একটি সমিতিই ছিল। একটা সময় কয়েকজন ব্যবসায়ী ইসলামিয়া থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে বাবুপুরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি গঠন করেন।
‘এখন ইসলামিয়ায় সদস্যসংখ্যা ৫৫৪ আর বাবুপুরার সদস্য প্রায় ২০০ জন। আমরা দুই সমিতির পক্ষ থেকেই আমাদের দখলে থাকা জমির লিজের আবেদন করে রেখেছি, তবে একজন ব্যক্তি এই জায়গা তার দাবি করে মামলা করেছেন। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জেলা প্রশাসন আমাদের লিজ এপ্রুভ করতে পারবে না। আর জমি লিজ পাওয়ার পর আমরা এই জায়গায় মার্কেট কীভাবে নির্মাণ করব, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
এই জমির কিছু অংশ নিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মধ্যে দ্বন্দ্বও চলছে। মালিকানার জটিলতা নিরসনে চলছে মামলা।
২০১৯ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মূল সড়ক ও ফুটপাতের ওপর কিছু অংশের জমির মালিকানা বুঝে পেতে মামলা করে। সেই মামলায় পরাজিত হয়ে করপোরেশন এখন হাইকোর্টে আপিল করেছে। আপিলটি শুনানির অপেক্ষায় আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. খায়রুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৮৬ সালে সড়ক নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলে ঢাকা জেলা প্রশাসন এই জায়গা সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়। অধিগ্রহণ করা জায়গায় সড়ক, ফুটপাত নির্মাণের পর বাকি জায়গায় রোডসাইড মার্কেট স্থাপন করা হয়। তখন থেকে এই রোডসাইড মার্কেটের মালিকানা ও দখল সিটি করপোরেশনের, তবে সবশেষ জরিপে সেখানে জেলা প্রশাসনের নামই রয়ে গেছে। এ কারণে মামলা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।’
তিনি বলেন, ‘মামলার রায় আমাদের অনুকূলে আসেনি। তাই আপিল করা হয়েছে। আশা করছি আপিল বিভাগ আমাদের পক্ষে রায় দেবে।’