বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অভিযোগ ‘নিষ্পত্তির পরও’ পুলিশ উজিরকে ধরে নিয়ে যায়

  •    
  • ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:৫০

চুরির ঘটনা ঘটে শান্তিগঞ্জের দরগাপাশা ইউনিয়নে। গরুর মালিক এবং আটক চারজনও এই এলাকার। মামলার বাদী উজিরের নাম বলেননি। সালিশ বৈঠকেও তার নাম আসেনি। তারপরও পাশের ইউনিয়নের যুবক উজিরকে পুলিশ কেন আটক করেছে সেই প্রশ্নের জবাব নেই কারও কাছে।

চুরির যে মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে উজির মিয়াকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ, সেই অভিযোগের বিষয়টি গ্রাম্য সালিশে আপস-মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল। এরপর থানায় একটি আপসনামাও জমা দিয়েছিলেন বাদী। আপসে নিষ্পত্তির পরও উজির মিয়াকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।

উজিরের পরিবার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মামলার সাক্ষীদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার শত্রুবর্ধন গ্রামের যুবক উজির মিয়া মারা যান ২১ ফেব্রুয়ারি। পরিবারের অভিযোগ, থানা হেফাজতে পুলিশের নির্যাতনে অসুস্থ হয়েই মারা গেছেন উজির। তার সঙ্গে আটক হওয়া অন্যরাও জানিয়েছেন থানায় উজিরকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে।

থানা পুলিশের এক উপপরিদর্শকের (এসআই) আত্মীয়ের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে উজিরকে পরিকল্পিতভাবে আটক ও নির্যাতন করারও অভিযোগ উঠেছে। আর যে গরু চুরির মামলায় তাকে আটক করা হয়, থানায় জমা দেয়া সেই মামলার এজাহারে‌ উজিরের নামও ছিল না।

এদিকে উজিরের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভ আর সুষ্ঠু তদন্তের দাবির মধ্যেই বুধবার পাশের দিরাই থানায় বদলি করা হয়েছে অভিযুক্ত এসআই দেবাশীষ সূত্রধরকে।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

গত ১৩ জানুয়ারি গো-চারণ ভূমি থেকে আমরিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুর উদ্দিনের একটি গরু হারায়। পরে খবর আসে যে পাশের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার এক বাজারে গরু ও অটোরিকশাসহ চারজনকে আটক করেছে স্থানীয়রা। শান্তিগঞ্জ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) থানার এসআই দেবাশীষসহ কয়েকজন পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে যান নুর উদ্দিন। সেখান থেকে গরু ও অটোরিকশা উদ্ধার এবং চারজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।

পরদিন এই চারজনসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে থানায় গরু চুরির মামলা করেন নুর উদ্দিন। মামলার আসামিরা হলেন- আমরিয়া গ্রামের মোস্তাকিম মিয়া, ছাদিকুর রহমান, সালমান হোসেন ও আব্দুল মোতালিব।

জামিন পেয়ে বাড়ি ফেরার পর উজির মিয়ার চোখে ছিল জল, সারা শরীরে পিটুনির চিহ্ন। তার দুই হাত ক্রমাগত কাঁপছিল। ছবি: ভিডিও থেকে নেয়া।

আপসে নিষ্পত্তি

নুর উদ্দিন থানায় যখন মামলা করেন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন একই এলাকার মতচ্ছির আলী। মামলার চার নম্বর সাক্ষী তিনি।

বৃহস্পতিবার তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নুর উদ্দিন মামলা করতে চাননি। কিন্তু পুলিশ জানায়, উদ্ধারকৃত গরু আদালতের মাধ্যমে ছাড়িয়ে নিতে হবে। তাই একটি লিখিত অভিযোগ দিতে হবে। এই কথা শুনে লিখিত অভিযোগ দেয় নুর উদ্দিন।’

গরু চুরি মামলার বাদী ও নাম উল্লেখ করা চার আসামির বাড়ি উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নে। এই ইউনিয়ন পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে বলেন, গরু আটকের পরপরই সেখান থেকে একজন ইউপি সদস্য আমারে কল দেন। আমি নুর উদ্দিনকে খবরটি জানাই এবং সেখানে যেতে বলি। এরপর জানতে পারি- এই ঘটনায় যাদের আটক ও মামলায় আসামি করা হয়েছে তারা সকলেই আমার এলাকার। আসামিপক্ষের লোকজনও আমার কাছে এসে বিষয়টি আপসে নিষ্পত্তির অনুরোধ করেন।

‘তাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আমি নুর উদ্দিনকে আপসের প্রস্তাব দেই। তাকে বলি, আসামিরা আর এই কাজ করবে না বলে কথা দিয়েছে। ক্ষতিপূরণও দেয়া হবে। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ওই রাতেই নুর উদ্দিন থানায়ও আপসের কথা জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরদিনই সব আসামি আদালতের মাধ্যমে জামিন পান।’

এরপর গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমেও বিষয়টি আপসে নিষ্পত্তি হয়েছিল বলে জানান নুর উদ্দিনের মামলার সাক্ষী মতচ্ছির আলী। তিনি বলেন’, এই ঘটনার কিছুদিন পরই গ্রামে সালিশ বৈঠক বসে। ঠিক কবে সালিশ বসেছিল তা এখন মনে নেই। তবে মাসখাসেক আগে তো হবেই। সালিশে আমিও ছিলাম। ওই দিনই বিষয়টি শেষ হয়ে যায়।’

উজির মিয়া কেন গ্রেপ্তার

ঘটনা ঘটে শান্তিগঞ্জের দরগাপাশা ইউনিয়নে। গরুর মালিক ও আটক চারজন একই এলাকার। অথচ ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে পাশের পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্ধন গ্রামের যুবক উজির মিয়াকে আটক করে পুলিশ। কেন এই মামলায় উজিরকে আটক করা হয় সে জবাব নেই স্থানীয়দের কাছেও।

সাবেক চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন বলেন, ‘উজির মিয়াকে ভালো ছেলে বলে জানি। গরু চুরি মামলায় তার সম্পৃক্ততার কথা শুনিনি। তবু এই মামলায় তাকে কেন আটক করা হলো বলতে পারব না।

মামলার সাক্ষী মতচ্ছির আলী বলেন, ‘গরু উদ্ধার, মামলা দায়ের, সালিশ বৈঠক- সব সময়ই আমি উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু এই ঘটনায় উজির মিয়ার সম্পৃক্ততার কথা কেউ কখনো বলেননি। বাদীও তার নাম বলেননি। তবু তাকে কেন আটক করা হলো তা পুলিশই ভালো বলতে পারবে।’

উজির মিয়ার ভাই ডালিম মিয়া বলেন, ‘গরু চুরির ঘটনা আরেক ইউনিয়নে। ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ভাইকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরই ওই চুরির বিষয়টি জানতে পেরেছি।’

এই ঘটনার পর থেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানা পুলিশ। আপসের পরও উজিরকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বৃহস্পতিবার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মুক্তাদির হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গরু চুরির মামলায় কোনো আপস হয়েছে কি না তা আমার নলেজে নেই। তখন আমি ছুটিতে ছিলাম। আর এই ঘটনায় এখন উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত চলছে। ফলে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’

ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় পরিবার

৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বাড়ি থেকেই উজির মিয়াকে মারতে মারতে পুলিশ থানায় নিয়ে যায় বলে অভিযোগ পরিবারের। পরে উজির মিয়াকে থানায় নিয়েও ব্যাপক নির্যাতন করা হয় বলে জানান তারা। পরদিন তাকেসহ চারজনকে নুর উদ্দিনের গরু চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। ওই দিনই আদালত থেকে উজির মিয়াসহ তিনজন জামিনে ছাড়া পান। শামীম মিয়া নামে একজনকে কারাগারে পাঠায় আদালত।

পরিবারের সদস্যরা জানান, জামিন পাওয়ার পর উজিরকে বাড়িতে আনা হয়। তখন তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তিনি দাঁড়াতে ও কথা বলতে পারছিলেন না। এরপর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দুই দিন চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে তাকে আবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সোমবার সকালে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে স্থানীয় কৈতক হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

উজিরের সঙ্গে জামিন পান আক্তার মিয়া (বামে) ও শহীদ ইসলাম

পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

উজির মিয়ার ভাতিজা ইমরান হোসেন বলেন, থানা পুলিশ মামলা না নিলে আমরা আদালতে যাব।

তদন্ত শেষ হয়নি

উজির মিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়। বৃহস্পতিবার এই দুটি কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা প্রতিবেদন জমা দেয়নি। যদিও তদন্তকাজ শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন দুই কমিটির প্রধান।

জেলা পুলিশের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবু সাঈদ বলেন, ‘আমরা সাক্ষীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষা করছি। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।

জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার-উল-হালিম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমাদের তদন্তকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দ্রুতই প্রতিবেদন জমা দেব।’

তবে তদন্তে পাওয়া তথ্য সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

এ বিভাগের আরো খবর