সহপাঠীকে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ প্রতিবাদ ও জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনরত গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে।
এতে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গুরুতর অবস্থায় একজনকে পাঠানো হয়েছে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন। তবে ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দাবি, হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
বৃহস্পতিবার বিকেল সোয়া পাঁচটার পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের গাড়ি, একটি লোকাল বাস ও একটি ট্রাক ভাঙচুর করা হয়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। বন্ধ থাকার ১১ ঘণ্টা পর মহাসড়কে যান চলাচল শুরু হয়।
এর আগে জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানার নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করেন পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ওই বৈঠক থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেয়া হয়। তবে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকলে হামলার শিকার হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রাজিউর রহমান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বুধবার রাতে জেলা প্রশাসন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নির্মাণাধীন ভবনে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষার্থীরা হল থেকে বেরিয়ে আসেন। থানায় অভিযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সারা রাত ক্যাম্পাসে অবস্থানের পর ভোরে সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তারের দাবিতে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী হেঁটে সদর থানায় অবস্থান নেন। তারা বিচার চেয়ে ৩ দফা দাবি ও আল্টিমেটাম দেন।
পরে সদরের ঘোনাপাড়ায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে চরম ভোগান্তির শিকার হন গন্তব্যে ছোটা মানুষ। অনেকে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে রওনা দেন।
তবে দাবি আদায়ে অনড় থাকেন বিক্ষুব্ধরা। প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের একজন নিউজবাংলাকে জানান, সদর উপজেলার নবীনবাগের হেলিপ্যাড এলাকায় দাঁড়িয়ে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন ওই ছাত্র্রী। এ সময় অটোরিকশা থেকে নামে সাত থেকে আটজন। তারা ছাত্রী ও তার বন্ধুকে জেলা প্রশাসন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে যায়। সেখানে বন্ধুকে মারধর করে ওই ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে।
বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ধার করে প্রথমে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেন। পরে ওই ছাত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বেলা গড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরও বেগবান হয়। সড়কে ‘প্রতিবাদী’ আলপনাও আঁকেন তারা। বেলা আড়াইটার দিকে জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা, পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকা, ভিসি একিউএম মাহাবুব, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব আলী খান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে যান। আলোচনার পর বিকেল সোয়া ৪টার দিকে শিক্ষার্থীদের সড়ক থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন তারা। তবে শিক্ষার্থীরা অবরোধ না তুলে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় তাদের ওপর হামলা হয়।
হামলার শিকার শিক্ষার্থী মো. ফরহাদ বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার সময় হঠাৎ ৪০/৫০ জন লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। এতে অনেকে আহত হয়েছেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এ হামলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা জড়িত। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলন বানচাল করতে ছাত্রলীগ নেতারা সব সময়ই তৎপর। হামলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাদের আটক করা না হলে আগামীকালও আমরা সড়কে অবস্থান নেব।’
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিউটন মোল্লা। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগ একাত্মতা জানিয়ে ৫ ঘণ্টা আন্দোলন করেছে। প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা করে দিয়েছে। তারপর আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসে ফিরে যান। তবে আমি শুনেছি, এর পরও কিছু ছাত্রশিবির ও বাম সংগঠনের কর্মীরা আন্দোলন করতে থাকেন। তখন তাদের স্থায়ীয়রা সরিয়ে দিয়েছে।’
আহতরা যা বলছেন
জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে ফরহাদ, সুমন, হুসাইন ও দিপংকর নামে চার শিক্ষার্থীকে। এ ছাড়া উন্নত চিকিৎসার জন্য সাদ্দাম রাজ নামে স্নাতকোত্তর শ্রেণির একজনকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে।
হামলার সময় আহত স্থানীয় একজনকেও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে জেনারেল হাসপাতালে।
চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থী মো. সুমন বলেন, ‘কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই আমাদের ওপর হামলা হয়েছে। ইট-পাটকেলের আঘাতে অনেকে আহত হয়েছেন। তারা স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়েছেন। হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করার দাবি জানাচ্ছি।’
গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক অসিত কুমার মল্লিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যারা এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন তারা আশঙ্কামুক্ত।’
প্রশাসন যা বলছে
গোপালগঞ্জ সদর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শীতল চন্দ্র পাল বলেন, ‘প্রক্টরের অভিযোগ পাওয়ার পরপরই অভিযান চালিয়ে নবীনবাগ এলাকার পিয়াস সিকদার, কলোনির অন্তর জমাদ্দার ও জীবন জমাদ্দারকে আটক করেছে পুলিশ। আজ প্রক্টরের অভিযোগ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হলে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ঘটনায় জড়িত অন্যদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) নিহাদ আদনান তাহিয়ান বলেন, ‘ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এসেছে। জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করা এখন সহজ হবে।’
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একিউএম মাহাবুব বলেন, ‘এটি একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে। যাতে এমন ঘটনা ফের না ঘটে।’
পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক না কেন, কাউকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, ‘আমি পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করেছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ব্যবস্থা করবেন।’
আটকদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে দুজন হরিজন সম্প্রদায়ের। তাদের মুক্তির দাবিতে ওই সম্প্রদায়ের লোকজন গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সামনের সড়কে ময়লা ফেলে রাখে। প্রশাসনের আশ্বাসে পরে তারা তা অপসারণ করে নেয়।