দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালকের পদ থেকে শরীফ উদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে কক্সবাজারের একটি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত অনিয়ম।
কক্সবাজার জেলার ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ে ২০২০ সালের ১০ মার্চ দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে শরীফ উদ্দিন যে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে কমিশন বিধিমালা অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
২০১৯ সালে কক্সবাজারে পিবিআই অফিস, এসপিএম প্রকল্প ও পানি শোধনাগারের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে আলাদা তিনটি অভিযোগপত্র দুদকে জমা দিয়েছিলেন দুদকের চাকরিচ্যুত উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন। রহস্যজনক কারণে দুদক ওই অভিযোগপত্রগুলো অনুমোদন করেনি, বরং সেগুলো ফের তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছিলেন তৎকালীন সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২-এর উপপরিচালক মাহবুবুল আলম।
নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগপত্রের সুপারিশ কমিশনে পাঠানোর কথা থাকলেও ওই কর্মকর্তা তা অনুসরণ করেননি। শরীফের বদলির তিন মাস পর তা কমিশনে পাঠানো হয়।
সুপারিশ গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশনা দেয়া ওই কর্মকর্তা বর্তমানে ঢাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে বদলি হয়ে গেছেন। শরীফের চট্টগ্রামের সহকর্মীরা মন্তব্য করেছেন ‘প্রাইজ পোস্টিং’ হিসেবেই উপপরিচালক মাহবুবুল আলমকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে মিডিয়ায় কথা বলার এখতিয়ার নাই। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সব কমিশনের সচিব মহোদয় অবগত আছেন, যা বলার দরকার উনারা বলবেন।’
কেন শরীফের তিনটি অভিযোগপত্রের সুপারিশ গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, এর কারণ খুঁজেছে নিউজবাংলা।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ, নথি ও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি থাকার পরও কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়মে শরীফের দেয়া তিনটি চার্জশিটে অনুমোদন দেয়া হয়নি। এমনকি ফের কোনো কারণও উল্লেখ করা হয়নি। এর মাধ্যমে মূলত সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এতে করে অভিযুক্তরা লাভবান হয়েছে।
বর্তমানে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত অনিয়ম ফের তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন কক্সবাজার জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন। নিউজবাংলাকে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘চলতি মাসের শুরুতেই কক্সবাজারে তিন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির ফের তদন্তের দায়িত্ব বুঝে পেয়েছি। বর্তমানে চট্টগ্রামে এসেছি ফাইলপত্র বুঝে নিতে। কক্সবাজার জেলা সমন্বিত দুদক কার্যালয়ের অধীনে এটি তদন্ত করা হচ্ছে।
‘আমার আগে শরীফ উদ্দিন এটির তদন্ত করলেও তাতে কোনো ভুল ছিল কি না তা আবার তদন্ত শেষ হওয়ার আগে বলতে পারব না। তবে কেন ফের তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা চিঠিতে উল্লেখ আছে। এ মুহূর্তে তা বিস্তারিত বলতে পারছি না। তবে কয়েকটি অভিযোগের ভিত্তিতেই এ পুনরায় তদন্ত।’
কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে ২ হাজার কোটি টাকার অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে ৭৩০ পাতার প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন শরীফ উদ্দিন। এতে কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ভূমিসংক্রান্ত দায়িত্বশীলরা কে কীভাবে অনিয়মে জড়িয়েছেন তার উল্লেখ ছিল। এই তদন্ত প্রতিবেদনে আসামি করা হয়েছিল ১৫৫ জনকে।
বদলির আদেশ হওয়ার পর ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রতিবেদনটি দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক মাহমুদ হাসান ও সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর উপপরিচালক মাহবুবুল আলমকে জমা দেন শরীফ।
চাকরি থেকে অপসারিত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘আমার বদলির আগে এই প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠানোর জন্য ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার কাছে জমা দেই। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য ঢাকায় পাঠানোর কথা তাদের। কিন্তু তিন মাসেও তারা ঢাকায় তা পাঠাননি, বরং পরে তারা সেটি পুনরায় তদন্তের জন্য নির্দেশনা দিয়ে কমিশনে পাঠান।’
এ বিষয়ে দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক মাহমুদ হাসান বলেন, ‘এই প্রসঙ্গে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। বিষয়টি কেন্দ্র থেকে দেখভাল করা হচ্ছে।’
ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ‘প্রভাবশালীদের চাপে’ শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়েছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন গত ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তার কার্যালয়ে বলেন, ‘বাস্তবতা বিবেচনায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে কর্মরত জেলা পর্যায়ের ব্যক্তিদের আর কতটুকুই বা প্রভাব থাকতে পারে! কমিশনের প্রায় সব অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মচারী চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারের সংশ্লিষ্ট মামলায় উল্লিখিত অভিযুক্ত বা আসামি অপেক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বা উঁচু পদ-পদবির ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আদালতে বিচারের পর তাদের সাজাও হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করেননি। তাদের কারও কারণে কমিশনকে এভাবে বিব্রত হতে হয় না।’
তিনি বলেন, দুদক যে শরীফের বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ এনে তার চাকরিচ্যুতির কারণ জানিয়েছে, তাতে কক্সবাজারের সেই অভিযোগের পুনরায় তদন্তের আদেশ কেন দেয়া হয়েছে, তাও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনায় কে, কখন, কীভাবে, কী অপরাধ করেছে এবং অপরাধটি সংঘটনের সঙ্গে আসামিদের দায় সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। আসামিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ক্রিমিনাল চার্জ সমর্থনে সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সুস্পষ্টকরণ করা হয়নি। যাদের অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে, তাদের কেন অব্যাহতি প্রদান করা হবে, তার ব্যাখ্যা প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি। এ ছাড়া অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি ও দায়সারা গোছের প্রতিবেদনের কারণে কমিশন কর্তৃক তা বিবেচিত হয়নি। এ কারণে দুই সদস্যের টিম গঠন করে মামলাটির পুনরায় তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।