সুনামগঞ্জে পুলিশের হেফাজতে নির্যাতনে যার মৃত্যুর অভিযোগ নিয়ে তোলপাড়, সেই উজির মিয়ার বাড়ি ফেরার পর তার একটি ভিডিও এসেছে নিউজবাংলার হাতে।
এতে দেখা যায় মধ্যবয়সী উজিরের হাঁটুর নিচে মাংসপেশি, ঊরু, পিঠে কালসিটে অসংখ্য দাগ। মাথাতেও বেশ কিছু দাগ রয়েছে, যেগুলো মারধরের কারণে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিছানায় শুয়ে থাকা উজিরের হাত ক্রমাগত কাঁপছিল।
স্বজনরা জানিয়েছেন, বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার সময়ই উজিরকে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া দুজন জানিয়েছেন, থানায় গামছা দিয়ে বেঁধে, পরে ঝুলিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়। একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে উজিরসহ তিনজনকে পাঠানো হয় হাসপাতালে।
উজিরের সঙ্গে পুলিশের এক উপপরিদর্শকের পূর্ববিরোধের বিষয়টিও সামনে এসেছে।
সুনামগঞ্জে গরু চুরির মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ৯ ফেব্রুয়ারি উজির মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই দিন তার সঙ্গে গ্রেপ্তার করে থানায় নেয়া হয় আরও তিনজনকে।
উজির মিয়ার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন একই এলাকার শহীদ ইসলাম, আক্তার মিয়া ও শামীম মিয়া। তাদের মধ্যে উজির, শহীদ ও আক্তার ১১ ফেব্রুয়ারি জামিনে ছাড়া পান।
জামিনে মুক্তির ১১ দিনের মাথায় ‘চিরমুক্তি’ হয় উজিরের। মৃত্যুর পর স্বজনরা অভিযোগ করতে থাকেন, থানায় নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন তিনি। তবে পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করে, জামিনের ১১ দিন পর কারও মৃত্যু হলে তাদের ওপর কোনো অভিযোগ আসতে পারে না।
গরু চুরির অভিযোগে ১৪ জানুয়ারি শান্তিগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। এই মামলায় গ্রেপ্তারের পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্তি পান। এর ১১ দিন পর অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি সোমবার হাসপাতালে মারা যান উজির মিয়া।
মৃত্যুর পর ঘটেছে আরও নানা ঘটনা। মরদেহ নিয়ে পুলিশ সদস্যদের বিচারের দাবিতে মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছে এলাকাবাসী। সে সময় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার উজ জামানকে বহনকারী একটি গাড়ি উজির মিয়ার লাশ চাপা দিয়ে যায়। এই ঘটনায় এলাকায় এখনও ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে।
এর মধ্যে উজির মিয়ার বাড়ি ফেরার দিন তার ভিডিওটি আসার পর শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্দন এলাকায় গিয়ে জানা যায় নানা তথ্য।
সঙ্গে গ্রেপ্তার দুজনের অভিযোগ
উজির মিয়ার সঙ্গে গ্রেপ্তার শহীদ ইসলাম জানালেন, থানায় তাদেরকে পেটানো হয়েছে নির্মমভাবে। তিনি বলেন, ‘ওই দিন রাতে প্রথমে আক্তাররে, পরে উজির ভাইরে, তিন নম্বর আমারে ধরছে। কোনো জিজ্ঞাসা নাই, ধরিয়া সঙ্গে সঙ্গে বার করছে আমারে। তারার (পুলিশের) কাছে কোনো ডকুমেন্ট কোনো কিছু নাই। নিয়া আমারে সিএনজিত তুলছে। দুইটা থাপ্পড় মারছে। আর খালি কয়, মাল কই। আমি তো ইতা জানি না। ঘটনা কিরা (কী) বুঝছিও না।
‘থানায় নিয়া আমারে মারিয়া জিকাইলো (জিজ্ঞাসা করে) উজির মিয়াকে চিনি কি না। আমি বললাম, চিনি তো। আমার আগের বাড়ির সম্মানই মানুষ বড় ভাই।
‘এই কথা শুনিয়া উজির ভাইরে তারা অন্য রুম নিয়া বানা (পিটানো) দিছে। পরে আমার সামনে আনিয়া হেন্ডকাপ পরাইয়া লুঙ্গির কাচা করে প্রথমে সারা শরীরও মারছে। পরে পায়ের তলায়। এর পরে আমারেও বাঁধছে। বেঁধে পায়ের তলে মারছে।’
উজিরের সঙ্গে জামিন পাওয়া আক্তার মিয়াও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘আমি রাতে দোকানেই ঘুমাই। ওই দিন রাতে আমার দোকান বন্ধ করিয়া ঘুমাই গেছি। দুইজন আইয়া আমার টিনে বাড়ি দিয়া (দিয়ে) সিগারেট চাইল। কইলাম ইটা (সিগারেট) দিতে পারতাম না। মেচ (ম্যাচ) দিরাম (দিতে) কইছি (পারব)। ইকান (এটা) কইতেই (বলতেই) মারি দিসে লাথ দোকান। বাঁশের খারা (খুঁটি) একটা ভাঙি গেছে। পরে আমার মুখো দুইটা টুশি (ঘুষি) দিসে।
‘থানায় নিয়ে প্রথমে তাকেও (উজির) মারধর করা হয়। পরে এসআই দেবাশীষ তাকে বাধ্য করেন উজির মিয়াকে এই চুরির মামলায় গডফাদার বলার জন্য।’
আক্তার বলেন, ‘আমাকে মারার পর দেবাশীষ দারগা খালি কইন (জিজ্ঞাসা করেন) উজির ভাইরে চিনিনি। আমি কইছি গরু চুর (চোর) শামীম, তার সঙ্গে আরও অনেকজন আছে। ইকান (এটা) কইতে (বলতে) তারা আমারে আবার ঝুলায়া মাইর শুরু করছে। পরে আমি বেহুঁশ অবস্থায় খালি মাথা নাড়াইছি। হু কইছি।’
উজিরের সঙ্গে জামিন পান আক্তার মিয়া (বামে) ও শহীদ ইসলামআক্তার মিয়া বলেন, ‘সবার মধ্যে উজির মিয়াকেই সবচেয়ে বেশি মারা হইছে। ঝুলাইয়া মুখ-চোখ গামছা দিয়া বাধিয়া (বেঁধে) মারছোইন (মারছে)। তারা আমারে কইছে, তানরে (তাকে) গডফাদার কইতাম (বলতে)।’
তিন ঘণ্টা ধরে মারধরে উজির মিয়া জ্ঞান হারান বলে জানান আক্তার। তিনি বলেন, ‘উজিরের অবস্থা বেগতিক দেখে রাত প্রায় সাড়ে তিনটা নাগাদ পুলিশের গাড়িতে করি সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
আক্তার বলেন, ‘আমরারে ডাক্তারে কইছে, কিচ্ছু অইছে না, ঠিক অই যাইব। আর উজির ভাইরে বলে একটা ইনজেকশন দিলে ঠিক অই যাইব। ইকান শুনছি পরে আমরারে নিয়া আইচ্ছে।’
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই রাতে তাকে (উজির) হাসপাতালে নিয়ে আসার পর বমি হচ্ছিল, মাথা ঘুরাচ্ছিল। শরীর ছিল দুর্বল। পরে ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।’
শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখেছেন কি না- এমন প্রশ্নে সেই চিকিৎসক বলেন, ‘না, আমি এমন কিছু দেখি না। শরীর খুব দুর্বল দেখেছি।
নাম নেই এজাহারে
গরু চুরির মামলার বাদী উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের আমরিয়া গ্রামের নুর উদ্দিন। তিনি মামলায় ৮ জনের নাম উল্লেখ করেন। এজাহারে ৩ থেকে ৪ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলায় উজিরের নাম ছিল না।
এজাহারে বাদী যে মোবাইল নম্বর দিয়েছেন তা ব্যবহার করেন মামলার ৪ নম্বর সাক্ষী মতছির আলী। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নুর উদ্দিনের নিজের মোবাইল নেই। তাই হয়তো আমার নম্বর দিয়েছেন।’
নুর উদ্দিন বাড়ি থেকে দূরে অবস্থান করছেন জানিয়ে বাদীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে অস্বীকার করেন।
‘মারধর করা হয়েছে বাড়িতেও’
উজির মিয়াকে আটকে শান্তিগঞ্জ থানার এসআই দেবাশীষ সূত্রধর, এসআই পার্ডন কুমার সিংহ ও এএসআই আক্তারুজ্জামানের নেতৃত্বে প্রায় ২০ জনের একটি দল অংশ নেয়।
চাচাতো বোন শাবানা আক্তার ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রায় ২০ জন পুলিশ বাড়িতে আসে। আমার ভাই (উজির মিয়া) দরজা খুলতেই তারা ভাইরে দিসে মাইর। এরপর ডান হাতে আরেকটা মাইর দিয়ে ভাইয়ের কলারও ধরিয়া টানিয়া বাইরে নিসে।’
উজির এ সময় নিজেকে নিরপরাধ দাবি করেন। সে সময় পুলিশ তার দুই হাঁটুতে লাঠি দিয়ে আঘাত ও গালাগালি করে বলে জানান শাবানা।
তিনি বলেন, ‘আমারে ফালাইয়া টানিয়া আমার ভাইটারে নিয়া নিসে। বাড়ি থেকে মারতে মারতেই আমার ভাইরে থানায় নিয়ে গেছে। সেখানেও মারছে। পুলিশের নির্যাতনেই আমার ভাই মারা গেছইন। আমার ভাইরে যারা মারছে, তারার ফাঁসি চাই।’
উজিরের ছোট ভাই ডালিম মিয়া বলেন, ‘পুলিশ আইয়া আমার ভাইরে প্রথমে মাথাত মারছে। পরে দুই হাতও মারছে। তারা কয়, আমার ভাই নাকি চোর। যে আসল চোর তারে লগে লইয়া অভিযানে আইছিল পুলিশ। তারে পুলিশের জ্যাকেট আর জুতা লাগাইয়া আনছিল।’
ভাতিজা বাছির তালুকদার বলেন, ‘চাচারে ঘর থেকে বের হতেই মারধর করে পুলিশ। পরে থানায় নিয়ে টানা তিন ঘণ্টা মারধর করে।’
পূর্বশত্রুতার অভিযোগ
উজির মিয়াকে নির্যাতনের জন্য শান্তিগঞ্জ থানার তিন পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন এসআই দেবাশীষ সূত্রধর।
উজিরের পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০১৭ সালে পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রঞ্জিত সূত্রধরের সঙ্গে মারামারি হয়েছিল উজির মিয়ার। এসআই দেবাশীষ সেই রঞ্জিতের আত্মীয়।
উজিরের ভাই ডালিম মিয়া বলেন, ‘দেবাশীষ আমার ভাইরে থানায় মারছে আর কইছে- তুই রঞ্জিতরে মারছিলে না, তরে এমন মাইর দিমু তুই সাত দিনের ভিতরে মরবে।’
রঞ্জিত সূত্রধর পূর্ববিরোধ প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০১৭ সালে উজির মিয়া আক্রমণ করেছিল। তা দুবছর পরই মিটমাট হয়ে গেছে। তাদের বাড়িতে এখন আমার আসা-যাওয়া আছে। তার সাথে আমার বিরোধ ছিল না। এসআই দেবাশীষ আমার তালোই ঘরের ভাইর ভাগনা হয়।’
উজির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘উজির মিয়ার বিরুদ্ধে কখনই চুরির অভিযোগ শুনিনি। কোনো মামলাও তার বিরুদ্ধে ছিল না। তার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচার আমিও চাই।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে এস আই দেবাশীষ সূত্রধরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি। পরে এসএমএস করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এলাকাবাসী যা বলছেন
শত্রুবর্ধন গ্রামের লোকজন জোর দিয়েই বলেছেন, উজির চুরি করার মতো লোক নন।
স্থানীয় বাসিন্দা শামীম মিয়া বলেন, ‘উজির মিয়া প্রতিবাদী আছিল। যখন গ্রামও একটানা চুরি হওয়া শুরু হইছিল তাইন একলা ইটার প্রতিবাদ করছুইন। আমরা গ্রামবাসী সবরে এক করিয়া তাইন পুলিশরে জানাইছলা, মানুষটা ভালা আছিল। তেমন কোনো শত্রু আছিল না।’
উজিরের মরদেহ নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন এলাকাবাসীগ্রামের আয়না মিয়া বলেন, ‘এই পরিবারের কেউরে কোনো দিন চুরি করতে দেখছি না। তারা খুব শান্ত পরিবার। আর উজির তো দেশেই আইলো না ৬-৭ বছর আগে। পরে দেশো আইয়া ঘর আর ক্ষেতকৃষি লইয়া ব্যস্ত আছিল।’
প্রশাসনের তদন্ত কত দূর
উজির মিয়ার মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি করেছে পুলিশ।
জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঘটনায় কারও গাফিলতি বা উসকানি আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদ আনোয়ারকে প্রধান করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মুক্তাদির হোসেন বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ছুটিতে ছিলাম। তাই বিস্তারিত জানি না। তবে যে ঘটনা ঘটেছে, তা দুঃখজনক। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’
এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেনের সই করা অফিস আদেশে মঙ্গলবার এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার উল হালিমকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদিন ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একজন চিকিৎসককে রাখা হয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার উল হালিম নিউজবাংলাকে জানান, কমিটি মঙ্গলবার থেকেই কাজ শুরু করছে।
তবে এখন পর্যন্ত কী তথ্য পাওয়া গেল, সে বিষয়ে না প্রশাসনের, না পুলিশের তদন্ত দলের কেউ কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।