বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদসহ আরও বেশ কিছু দল। এরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গেই করে সবাই। এখনও এই জোটের সম্পর্ক অটুট। তবে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর নিজের এলাকা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পরিস্থিতি উল্টো। সেখানে দুই পক্ষ এখন মুখোমুখি।
আগে থেকে উত্তেজনার মধ্যে ভেড়ামারায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা খুন হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ ও জাসদ নতুন করে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। একে অপরকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। ছড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক উত্তাপ।
গত শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে ভেড়ামারার চাঁদগ্রাম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর মণ্ডলকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এই ঘটনায় জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলিম স্বপন, তার ছোট ভাই চাঁদগ্রাম ইউনিয়ন জাসদের সভাপতি ও চাঁদগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাফিজ তপনসহ ২০ জনের নামে মামলা করেন নিহতের চাচাতো ভাই এনামুল হক মণ্ডল।
জাসদকে দায়ী করে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের জন্য আলটিমেটাম দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের অভিযোগ, স্বাধীনতার পর গণবাহিনী গঠন করে জাসদ যেভাবে সশস্ত্র বিপ্লবের চেষ্টা করেছিল, এই ঘটনা সেই স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।
অন্যদিকে জাসদ নেতারা বলছেন, ৪০ বছরের পুরোনো সামাজিক দ্বন্দ্বের জেরে এই খুনের ঘটনা ঘটেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যেন তাদের সভাপতি ইনু হাসানুল হক ইনু বেকায়দায় পড়েন, সে জন্য রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে একটি চক্র একে রাজনৈতিক রং দিচ্ছে।
মামলা থেকে জাসদ নেতাদের নাম প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে দলটির ভেড়ামারা উপজেলা শাখা। রোববার বিকেলে ভেড়ামারা শহরে বিক্ষোভ দেখান দলের নেতা-কর্মীরা।
জাসদের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক এস এম আনসার আলী তার দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার না করলে আন্দোলনে নামার ঘোষণাও দেন।
এই জাসদ নেতা বলেন, এই এলাকায় তাদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু নির্বাচন করেন। সেই নির্বাচনকে লক্ষ্য করে জাসদকে দুর্বল করতে সুযোগ পেয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মিথ্যা মামলায় জড়ানো হচ্ছে।
এর আগে মরদেহ নিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তারাও জাসদ নেতাদের গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামীমুল ইসলাম সানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা হত্যার মাধ্যমে জাসদ গণবাহিনী আবার স্বরূপে ফিরেছে। তারা এই এলাকায় আবার অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখাতে চায়, পরিবেশ অশান্ত করতে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্মীরা তা কখনও হতে দেবে না। জনগণ তাদের প্রতিহত করবে।’
প্রশাসনের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘আসামিদের গ্রেপ্তার করুন। না হলে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে তার দায়ভার আপনাদেরই নিতে হবে।’
নেপথ্যে ইনু-হানিফের বিরোধ
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বাড়ি জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের।
ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলা মিলিয়ে কুষ্টিয়া-২ আসনে হাসানুল হক ইনু নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত আর মাহবুবউল আলম হানিফ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত কুষ্টিয়া-৩ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
দুজন দুই এলাকার সংসদ সদস্য হলেও নিজের এলাকায় তাদের অনুসারী নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা প্রবণতা দেখা যায়। তাদের মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকে, প্রায়ই ঘটে সংঘর্ষের ঘটনা।
আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভেড়ামারায় আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা নেতা-কর্মীরা আমাকে জানিয়েছেন। আমাদের একজন স্থানীয় নেতা খুন হয়েছেন। এটা জানার পর, আমি প্রশাসনকে আইনগতভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি। পাশাপাশি, নেতা-কর্মীদের শান্ত থাকতে বলেছি।’
জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক কোনো ঘটনা নয়। এটি স্থানীয় গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব। এটাকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি ঘটনা সম্পর্কে জানামাত্র, স্থানীয় প্রশাসনকে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি।’
অতীতের যত বিরোধ
২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় আওয়ামী লীগ-জাসদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এক দিন আগে বাহাদুরপুরে যুবলীগ অফিসে হামলার ঘটনার জের ধরে এ দিন দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ১০ জন আহত হন।
জাসদ নেতা-কর্মীরা ফারাকপুর রেলগেট এলাকায় সিরাজ মেম্বারের ডেকোরেটরে বসে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালান। হামলায় আহত হন বেশ কয়েকজন।
এই খবর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে তারা জাসদ কর্মীদের ধাওয়া করে। এ সময় তারা জাসদ কর্মীদের ফেলে যাওয়া একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে।
২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি ভেড়ামারার ইসলামপুর এলাকায় দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। সেদিন আওয়ামী লীগ ও জাসদের দুই নেতাকে কুপিয়ে জখম করা হয়।
ওই বছরের ২৪ জুন আরেক দফা সংঘর্ষ হয়। এতে তিনজন গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন।
গত বছরের ১৬ জানুয়ারি ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোটের শরিক দুই দল মুখোমুখি অবস্থান নেয়। দুই দলের নেতারা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করে ফেলেন।
১০ জানুয়ারি রাতে ভেড়ামারা পৌর এলাকার ৩ নং ব্রিজের কাছে মশাল সমর্থকরা ডকুমেন্টরি প্রজেক্টর চালাতে গেলে মশাল ও নৌকা সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয় হট্টগোল। সেখানে সংঘর্ষে আহত হন ভেড়ামারা উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মানিক মিয়া ও উপজেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক এস এম আনছার আলী। সেদিন কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পরে জাসদের নির্বাচনী অফিসে ভাঙচুর করা হয়।
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামিমুল হক সানাকে হারিয়ে জাসদের আনোয়ার কবীর টুটুল জেতেন।
সদ্যঃসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই পক্ষ সংঘর্ষে না জড়ালেও একে অন্যকে আক্রমণ করে কথা বলেছে। কার শক্তি কত বেশি, এ নিয়ে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দেয়া হয়েছে বহুবার।