গরু চুরির যে মামলায় সুনামগঞ্জের উজির মিয়াকে ধরেছিল পুলিশ, সেটির এজাহারে তার নাম উল্লেখ নেই। মূলত হয়রানি ও নির্যাতনের উদ্দেশ্যে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ স্বজনদের। তারা উজিরের মৃত্যুর পর পুরো ঘটনা ‘পরিকল্পিত’ বলে মনে করছেন।
পুলিশি নির্যাতনে উজিরের মৃত্যু নিয়ে অভিযোগের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন এলাকার লোকজন।
গরু চুরির মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে উজির মিয়াকে আটক করে পুলিশ। গত সোমবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান উজির মিয়া।
এ ঘটনায় সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলায় বিক্ষোভ হয়। সেখানে মরদেহে গাড়ি তুলে দেয়ার অভিযোগ নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আন্দোলনকারীরা।
উজির মিয়া শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্দন গ্রামের বাসিন্দা। মঙ্গলবার সেখানে গেলে পুলিশ নিয়ে নানা ক্ষোভের কথা জানান এলাকার লোকজন। আর উজিরের স্বজনরা পুরো ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ বলে দাবি করেন। শান্তিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দেবাশীষ সূত্রধর পূর্বশত্রুতার জের ধরে তাকে আটক ও নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ করেন তারা।
নাম নেই এজাহারে
গরু চুরির অভিযোগে ১৪ জানুয়ারি শান্তিগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। বাদী উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের আমরিয়া গ্রামের নুর উদ্দিন। তিনি মামলায় ৮ জনের নাম উল্লেখ করেন। এজাহারে ৩ থেকে ৪ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলায় উজিরের নাম না থাকলেও পুলিশ তাকে আটক করে।
এজাহারে বাদী যে মোবাইল নম্বর দিয়েছেন তা ব্যবহার করেন মামলার ৪ নম্বর সাক্ষী মতছির আলী। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নুর উদ্দিনের নিজের মোবাইল নেই। তাই হয়তো আমার নম্বর দিয়েছেন।’ নুর উদ্দিনের বাড়ি থেকে তিনি অনেক দূরে অবস্থান করছেন জানিয়ে বাদীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে অপারগতা জানান।
গ্রেপ্তারের পরদিন আদালতে তোলার সময় হাঁটতে পারছিলেন না উজির মিয়া। ছবি: নিউজবাংলাঘটনা পরিকল্পিত
৯ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে নিজ বাড়ি থেকে উজির মিয়াকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। শান্তিগঞ্জ থানার এসআই দেবাশীষ সূত্রধর, এসআই পার্ডন কুমার সিংহ ও এএসআই আক্তারুজ্জামানের নেতৃত্বে প্রায় ২০ জনের টিম এ অভিযানে অংশ নেয়।
চাচাতো বোন শাবানা আক্তার ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রায় ২০ জন পুলিশ বাড়িতে আসে। আমার ভাই (উজির মিয়া) দরজা খুলতেই তারা ভাইরে দিসে মাইর।
এরপর ডান হাতে আরেকটা মাইর দিয়ে ভাইয়ের কলারও ধরিয়া টানিয়া বাইরে নিসে।’
উজির এ সময় নিজেকে নিরপরাধ দাবি করায় পুলিশ তার দুই হাটুতে লাঠি দিয়ে আঘাত ও গালাগালি করে বলে জানান শাবানা।
তিনি বলেন, ‘আমারে ফালাইয়া টানিয়া আমার ভাইটারে নিয়া নিসে। বাড়ি থেকে মারতে মারতেই আমার ভাইরে থানায় নিয়ে গেছে। সেখানেও মারছে। পুলিশের নির্যাতনেই আমার ভাই মারা গেছইন। আমার ভাইরে যারা মারছে তারার ফাঁসি চাই।’
উজিরের ছোটভাই ডালিম মিয়া বলেন, ‘পুলিশ আইয়া আমার ভাইরে প্রথমে মাথাত মারছে। পরে দুই হাতও মারছে। তারা কয়, আমার ভাই নাকি চোর। যে আসল চোর তারে লগে লইয়া অভিযানে আইছিল পুলিশ। তারে পুলিশের জ্যাকেট আর জুতা লাগাইয়া আনছিল।’
ভাতিজা বাছির তালুকদার বলেন, ‘চাচারে ঘর থেকে বের হতেই মারধর করে পুলিশ। পরে থানায় নিয়ে টানা তিন ঘণ্টা মারধর করে।’
পূর্বশত্রুতার অভিযোগ
উজির মিয়াকে নির্যাতনের জন্য শান্তিগঞ্জ থানার তিন পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন এসআই দেবাশীষ সুত্রধর।
উজিরের পরিবার সদস্যরা জানান, ২০১৭ সালে পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের সদস্য রঞ্জিত সুত্রধরের সাথে মারামারি হয়েছিল উজির মিয়ার। এসআই দেবাশীষ সেই রঞ্জিতের আত্মীয়।
উজিরের ভাই ডালিম মিয়া বলেন, ‘দেবাশীষ আমার ভাইরে থানায় মারছে আর কইছে- তুই রঞ্জিতরে মারছিলে না, তরে এমন মাইর দিমু তুই সাতদিনের ভিতরে মরবে।’
রঞ্জিত সুত্রধর পূর্ববিরোধ প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০১৭ সালে উজির মিয়া আক্রমণ করেছিল। তা দুবছর পরই মিটমাট হয়ে গেছে। তাদের বাড়িতে এখন আমার আসা-যাওয়া আছে। তার সাথে আমার বিরোধ ছিল না। এসআই দেবাশীষ আমার তালোই ঘরের ভাইর ভাগনা হয়।’
উজির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘উজির মিয়ার বিরুদ্ধে কখনোই চুরির অভিযোগ শুনিনি। কোনো মামলাও তার বিরুদ্ধে ছিল না। তার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচার আমিও চাই।’
এলাকাবাসী যা বলছেন
শত্রুবর্ধন গ্রামের লোকজন জোর দিয়েই বলেছেন, উজির চুরি করার মতো লোক নয়।
স্থায়ী বাসিন্দা শামীম মিয়া বলেন, ‘উজির মিয়া প্রতিবাদী আছিল। যখন গ্রামও একটানা চুরি হওয়া শুরু হইছিল তাইন একলা ইটার প্রতিবাদ করসোইন। আমরা গ্রামবাসী সবরে এক করিয়া তাইন পুলিশরে জানাইছলা, মানুষটা ভালা আছিল। তেমন কোন শত্রু আছিল না।’
গ্রামের আয়না মিয়া বলেন, ‘এই পরিবারের কেউরে কোনদিন চুরি করতে দেখছি না। তারা খুব শান্ত পরিবার। আর উজিরতো দেশেই আইলো না ৬-৭ বছর আগে। পরে দেশো আইয়া ঘর আর খেতকৃষি লইয়া ব্যস্ত আছিল।’
তদন্ত করবে পুলিশ
উজির মিয়ার মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি করেছে পুলিশ।
জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঘটনায় কারও গাফিলতি বা উসকানি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদ আনোয়ারকে প্রধান করা হয়েছে। তিন কার্য দিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মুক্তাদির হোসেন বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ছুটিতে ছিলাম। তাই বিস্তারিত জানি না। তবে যে ঘটনা ঘটেছে, তা দুঃখজনক। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’
এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গির হোসেনের সই করা অফিস আদেশে মঙ্গলবার এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার উল হালিমকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদিন ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একজন চিকিৎসককে রাখা হয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার উল হালিম নিউজবাংলাকে জানান, কমিটি মঙ্গলবার থেকেই কাজ শুরু করছে।