সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনে চুরির মামলার আসামি উজির মিয়ার মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গির হোসেনের সই করা অফিস আদেশে মঙ্গলবার এ তথ্য জানানো হয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার উল হালিমকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদিন ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একজন চিকিৎসককে রাখা হয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার উল হালিম নিউজবাংলাকে জানান, কমিটি মঙ্গলবার থেকেই কাজ শুরু করছে।
চুরির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে মুক্তি পাওয়ার ১১দিন পর হাসপাতালে ভর্তি উজির মিয়ার মৃত্যু হয় সোমবার। স্বজনরা অভিযোগ করেন, গ্রেপ্তার অবস্থায় পুলিশ তাকে নির্যাতন করেছে। এর ধকলেই তিনি অসুস্থ হন এবং মারা যান।
উপজেলার পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্দন (বাঘেরকোনা) গ্রামে উজির মিয়ার বাড়ি। তিনি ছিলেন কৃষক।
তার পরিবারের অভিযোগ, শান্তিগঞ্জ থানার তিন এসআই দেবাশীষ রায়, পার্টন চন্দ্র দাস ও আক্তারুজ্জামান মিথ্যা মামলা দিয়ে উজির মিয়াকে হাজতে নিয়ে নির্যাতন করেছেন।
এই কষ্ট সহ্য না করতে না পেরেই তার মৃত্যু হয়েছে।
নিউজবাংলার কাছে আসা ছবিতে উজিরের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে
উজিরের ছোট ভাই ডালিম মিয়া বলেন, ‘আমার ভাইকে ৯ তারিখ মিথ্যা মামলা দিয়ে এসআই দেবাশীষ, পার্টন চন্দ্র দাস ও আক্তারুজ্জামান সন্দেহভাজন গরু চোর হিসেবে ধরে নিয়ে যায়। অথচ শত্রুমর্দন গ্রামের সবাই বলতে পারবে- আমরা কেমন পরিবারের সন্তান। তারা আমার ভাইকে গ্রেপ্তার করে সারা রাত হাজতে মেরেছে।’
ডালিম জানান, গ্রেপ্তারের পরদিন আদালতে নিজে থেকে হেঁটে যেতে পারছিলেন না উজির। মারধরের সময় তিনি পুলিশকে কাকুতিমিনতি করে বলেছিলেন, ‘আপনে সবরে জিকাইন। আমার গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যান যদি আমারে চুর কয়, আমি ফাঁসিত ঝুলি যাইমু। তবুও মাইরোইন না আমারে।’
ডালিম বলেন, ‘তারা আমার ভাইয়ের কথা শুনেনি। তারা আমার ভাইকে আগেই ৭ দিনের মধ্যে জেলে ঢুকানোর হুমকি দিয়েছিল। ভাইয়ের সারা শরীরে মাইরের দাগ। তারা মাথায়ও মেরেছে।’
নিহতের ভাতিজা ইমরান হোসেন তালুকদার বলেন, ‘জামিনের পর চাচারে প্রথমে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছি। পরে তার অবস্থা খারাপ দেখে সিলেট ওসমানী মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। সেখানে এক সপ্তাহ চিকিৎসা নেয়ার পর গতকাল (রোববার) তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। এ অবস্থায় কৈতক হাসপাতালে নেয়া হলে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি মারা যান। আমরা এই পুলিশ সদস্যদের বিচার চাই, আমার চাচা নির্দোষ ছিলেন।’
উজির মিয়া জামিনে মুক্ত হওয়ার পর এবং আটকের পরদিন আদালতে তোলার সময়কার কয়েকটি ছবি নিউজবাংলার হাতে এসেছে। এসব ছবিতে উজির মিয়ার শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারধর ও জখমের চিহ্ন দেখা গেছে। এ ছাড়া তার মাথায় ডান দিকে একটি বড় আঘাতের চিহ্নও দেখা গেছে।
তার মৃত্যুর পর অভিযুক্ত তিন পুলিশ সদস্যের বিচার দাবিতে সোমবার মরদেহ নিয়েই মানববন্ধন ও পাগলা এলাকার সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেন এলাকাবাসী। এর মধ্যে একটি গাড়ি সেই মরদেহকে চাপা দিয়ে এগিয়ে যায়।
গাড়িটিতে বসা ছিলেন স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তবে গাড়িটি উপজেলার সহকারী কমিশনারের।
এতে অবরোধে বসা জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা মাটিতে বসে চালকের বিচার দাবি করতে থাকে।
গাড়িতে বসেছিলেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার উজ জামান। তিনি দাবি করেছেন, তাকে বহনকারী গাড়ি মরদেহকে চাপা দেয়নি। জনতা তার গাড়িতে হামলা করেছিল। চালক তখন মরদেহটি পাশ কাটিয়ে গেছে।
তবে এ ঘটনার দুটি ভিডিও ক্লিপ হাতে এসেছে নিউজবাংলার হাতে, যাতে ইউএনওর দাবি অসত্য বলে দেখা যায়।
ভিডিওতে দেখা যায়, শান্তিগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার সখিনা আক্তারের গাড়ি আসে ঘটনাস্থলে। জনতা গাড়িটিকে সামনে যেতে বাধা দিলে চালক না থেমে রাস্তায় রাখা উজির মিয়ার লাশকে চাপা দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। সে সময় জনতা রাস্তায় নেমে এলে তাদের ওপর দিয়েও চালিয়ে যাওয়া হয় গাড়িটি। তবে সে সময় তারা বাধা না দিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী উজির মিয়ার চাচা মখলেছুর রহমান বলেন, ‘লাশটা রাস্তায় রাখা। ইউএনও সাহেব তো নামিয়া আমরার কথা শুনতে পারতা। কিন্তু তাইন গাড়ি দিয়া মরা লাশটারে চাপা দিয়া গেলা। আমরা এমন ইউএনও চাই না।’
জানতে চাইলে স্থানীয়দের অভিযোগ অস্বীকার করে ইউএনও মো. আনোয়ার উজ জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মরদেহকে গাড়ি চাপা দেয়া হয়নি। উত্তেজিত জনতা আমার গাড়ির দিকে হামলা চালায় এবং গাড়ির কাচে আঘাত করতে থাকে। এ সময় ড্রাইভার লাশটির পাশ কাটিয়ে চলে যায়। যারা এই অভিযোগ করছেন সেগুলো মিথ্যা। এমন কিছু সেখানে হয়নি।’