অনেক চেষ্টার পর শ্যাওড়াপাড়া থেকে বাসে উঠেছেন সানজিদা খাতুন। গন্তব্য মহাখালী। ইঞ্জিনকাভারে বসে কথা প্রসঙ্গে জানান, বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে অভ্যর্থনা ডেস্কে চাকরি তার, বেতন সামান্য। আগের চাকরিতে বেতন ভালো ছিল। কিন্তু করোনায় বন্ধ হয়ে গেছে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড।
সানজিদা জানান, সংসারে ব্যয় সামাল দিতে চাকরির বিকল্প নেই। আগে সিএনজি কিংবা রাইড শেয়ার বাইকে চলাচল করলেও এখন ব্যয় সাশ্রয়ের কারণে বাসই ভরসা। বাজারে গেলে বেতনের সবই শেষ হয়ে যায়। বলেন, স্বামী ও এক সন্তানসহ তিন জনের সংসারে মাসে সয়াবিন তেল লাগে চার লিটার। শুধু তেলেই মাসে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫০ টাকা। মাছ, মুদি পণ্য কিনতে গিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা।
শুধু সানজিদা নয়; ব্যয়ের দৌড়ে তাল মেলাতে পারছে না নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, মূল্যস্ফীতি মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যে হারে ব্যয় বাড়ছে, সেই হারে বাড়ছে না আয়। ফলে বিপদে পড়েছে নিম্নবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্ত শ্রেণিও চাপের মুখে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা কনজ্যুমার ফোরাম-এর এক গবেষণা তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে পণ্যমূল্য বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছে এটা ঠিক। কিন্তু তার চেয়েও বেশি গতিতে উত্তপ্ত হচ্ছে স্থানীয় বাজার। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সিন্ডিকেট ক্রেতাদের জিম্মি করে প্রতিনিয়তই বাড়াচ্ছে দাম।
রাজধানীর হাতিরপুল কাঁচাবাজার। সবজির দাম আর সামর্থ্য মেলাতে গিয়ে হিমশিম ক্রেতা। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
কনজ্যুমার ফোরামের গবেষণা
২০২১ সাল জুড়ে বাজার দরের গতিবিধি বিশ্লেষণ করেছে কনজ্যুমার ফোরাম। সংস্থাটি বলছে, গত এক বছরে গড়ে পণ্যমূল্য বেড়েছে ১০ দশমিক ৪৬ ভাগ।
হিসেব বলছে, এই এক বছরে সব রকম চালের দাম বেড়েছে গড়ে প্রায় ৮ শতাংশ। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম ছিল ২৮০০ টাকা। চলতি জানুয়ারিতে সেটা কিনতে ভোক্তাকে গুনতে হয়েছে ৩ হাজার ৫০ টাকা।
আটা-ময়দা-সুজির দাম বেড়েছে ২০ ভাগের বেশি। গত বছরের জানুয়ারিতে ২ কেজি প্যাকেট আটার দাম ছিল ৭৬ টাকা। চলতি জানুয়ারিতে একই পরিমাণ আটা কিনতে ভোক্তাকে গুণতে হয়েছে ৯৪ টাকা।
প্রায় ১৪ ভাগ বেড়েছে ডালের দাম। গত জানুয়ারিতে এক কেজি দেশি মসুর ডাল ছিল ১২৫ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এক কেজি মসুর ডালে ভোক্তার ব্যয় ১৪৫ টাকা।
২০ ভাগের বেশি বেড়েছে চিনির দাম। এক কেজি চিনি কিনতে ভোক্তাকে ৭২ টাকার জায়গায় এখন ৮৫ টাকা গুণতে হচ্ছে।
ভোজ্যতেলের দাম প্রায় বেড়েছে ১৬ ভাগ। গত জানুয়ারিতে ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের মূল্য ছিল ৬৫০ টাকা। চলতি বছর জানুয়ারিতে সেটা বেড়ে ৭৬০ টাকা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে তা আরেকদফা বাড়িয়ে হয়েছে ৭৯৫ টাকা।
এ ছাড়া সরিষার তেলের দাম এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ১০ শতাংশ ও নারকেল তেলের দাম ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়েছে।
সব ধরণের গুড়া মসলার দাম বেড়েছে ১১ ভাগের বেশি।
সাবান, ডিটারজেন্ট ও হ্যান্ডওয়াশের দাম ১০ শতাংশ বেড়েছে। থালা-বাসন পরিষ্কার করার উপকরণ ভিমবারের দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ। হারপিক ও লাইজলের দর বেড়েছে ২ দশমিক ৬ ভাগ।
এ ছাড়া গুড়া দুধ ৯ শতাংশ, নুডলস ও স্যুপ ১ দশমিক ৬১ শতাংশ, ঘি সাড়ে ৮ শতাংশ, টুথপেস্ট ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ, টিস্যু বা সমজাতীয় পণ্যের দর ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়েছে।
কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, ‘২০২০ সালে করোনা শুরুর পর অনেক মানুষ কাজ-কর্ম হারিয়ে এখন বেকার দিন পার করছে। ফলে দারিদ্র্য বাড়ছে। পণ্যমূল্য যাই থাকুক না কেন, যদি ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তাহলে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু করোনা ও মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপটে সাধারণ মানুষের আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। এই অবস্থায় যদি পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য জনগণের নাগালের মধ্যে না থাকে, তাহলে সরকারের প্রচেষ্টা ও উন্নয়নের ইতিবাচক দিকগুলো ম্লান হয়ে যাবে।
কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতের সুযোগ নেই। মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুটে ক্রেতার উপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করায় যে সংকট ও অব্যবস্থাপনা, তার আশু সমাধান জরুরি।
সাধারণ মানুষের অস্তিত্বের স্বার্থে নিত্যপণ্যের মূল্য ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জোর দাবি করে তিনি বলেন, আর কিছুদিন পরই রোজা শুরু। এ সময় যেন কোনো পণ্যের অযাচিত মূল্য না বাড়ে, সে বিষয়ে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
লক্ষ্যমাত্রার বেশি মূল্যস্ফীতি
চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি তার চেয়েও বেশি। মূল্যস্ফীতি যে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, তা স্বীকার করছে সরকারও।
সরকারি সংস্থা পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছাড়িয়ে যায় ৬ শতাংশ। অথচ চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৫ শতাংশের ঘরে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার আশ্বাস দেয় সরকার।