দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সুনামগঞ্জ ও সিলেটের ১০৮টি গ্রামে বসবাস হাজং সম্প্রদায়ের। রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তবে মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগবঞ্চিত হাজং শিক্ষার্থীরা।
ভাষাগত প্রতিবন্ধকতায় প্রাক-প্রাথমিকেই পিছিয়ে পড়ছে হাজং শিশুরা, পাশাপাশি হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের ভাষাবৈচিত্র্য।
সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে হাজং জনসংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। গারো পাহাড় অঞ্চলে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার নাম ‘হাজং ভাষা’।
এ ভাষার সঙ্গে অহমিয়া ও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ থাকলেও উচ্চারণগত ভিন্নতা আছে। স্কুলে এ ভাষা চর্চার সুযোগ না থাকায় ধীরে ধীরে বাংলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে হাজং শিশুরা।
বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পল্টন হাজং নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাজং জনগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মধ্যে হাজং ভাষায় কথা বলেন। এ কারণে তাদের ছেলেমেয়েরাও হাজং ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তবে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই খুব সমস্যায় পড়ে যায়। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজং ভাষার প্রচলন নেই।
দুর্গাপুরের হাজং কমিউনিটির নেতা ও অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক মতিলাল হাজং নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাজং জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় পড়ালেখা করলেও বাংলার সঙ্গে হাজং ভাষার উচ্চারণগত ভিন্নতা রয়েছে। হাজং ভাষা লিখতে গেলে বাংলা হরফের সঙ্গে আমাদের আরও তিনটি সাংকেতিক চিহ্ন যোগ করতে হয়। ভারতে বসবাসরত হাজংদের অনুকরণে আমরা ওই তিনটি সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে নিজ ভাষা লেখি।’
‘এ ছাড়া বেশির ভাগ শিক্ষক বাঙালি। এ কারণে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক- উভয়েরই পরস্পরের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয়। হাজং শিশুরা খুব সহজে বাংলা ভাষা আয়ত্ত করতে পারে না। বাংলা আয়ত্ত করতে করতে তারা অন্য শিক্ষার্থীর তুলনায় পিছিয়ে যায়। এভাবে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই তাদের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।’
প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকে হাজং ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ তৈরির তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে এ দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাঁওতাল ভাষায় কারিকুলাম তৈরি করলেও এখনও হাজং ভাষায় কারিকুলাম তৈরির উদ্যোগ নেয়নি।’
দুর্গাপুরের হাজং কমিউনিটির নেতা ও অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক মতিলাল হাজং নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাজং জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় পড়ালেখা করলেও বাংলার সঙ্গে হাজং ভাষার উচ্চারণগত ভিন্নতা রয়েছে। হাজং ভাষা লিখতে গেলে বাংলা হরফের সঙ্গে আমাদের আরও তিনটি সাংকেতিক চিহ্ন যোগ করতে হয়। ভারতে বসবাসরত হাজংদের অনুকরণে আমরা ওই তিনটি সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে নিজ ভাষা লেখি।’
তিনি বলেন, ‘নিজ ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় হাজং ভাষার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। তারা হাজং ভাষা ভুলে যাচ্ছে। শেরপুরের ঝিনাইগাতি ও নালিতাবাড়ির বেশির ভাগ হাজং ছেলেমেয়ে এখন নিজেদের মধ্যেও বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ রকম চললে ভাষাটি টিকবে না।’
হাজং ও বাংলা ভাষা শেখাতে বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠন, হাজং মাতা রাশিমণি কল্যাণ ট্রাস্ট, অক্সফাম ও পপিসহ কয়েকটি এনজিওর উদ্যোগে দুর্গাপুর উপজেলার গোপালপুর, মেনকি, লক্ষ্মীপুর ও ভবানীপুর এলাকার শিশুদের নিয়ে প্রাক-প্রাথমিকের আদলে কয়েকটি হাজং বিকাশ কেন্দ্র চালু করা হয়েছিল। হাজং ভাষায় কয়েকটি পাঠ্যবইও ছাপানো হয়েছিল। তবে কয়েক বছর চলার পর অর্থাভাবে ওই পাইলট প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়।
মতিলাল হাজং ও পল্টন হাজং মনে করছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ধরনের পাঠদান ব্যবস্থা চালু করলে হাজং শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। তারা সহজেই হাজং ও বাংলা ভাষার উচ্চারণ এবং সমার্থক শব্দগুলো আয়ত্ত করতে পারবে।
বিদ্যালয়ে হাজং শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানিয়ে তারা বলেন, সবশেষ প্রণীত শিক্ষানীতিতেও ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠীর ভাষার বিকাশে জোর দেয়া হয়েছে।
হাজং নেতারা জানান, দিনদিন বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত হওয়ার কারণে তাদের নিজ ভাষায় রচিত গান, গল্প, কবিতা, ধাঁধা ও প্রবাদ-প্রবচনসহ লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির অনেক উপাদান-অনুষঙ্গও হারিয়ে যাচ্ছে। আগে সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসব-পার্বণে হাজং ভাষার গান ও নৃত্যগীত দেখা যেত। এখন সেখানেও বাংলা ভাষা প্রাধান্য পাচ্ছে। লেখালেখিতেও কমে গেছে হাজং ভাষার ব্যবহার।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি’-এর পরিচালক সুজন হাজং নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একাডেমির উদ্যোগে হাজং ভাষায় লেখা গান, কবিতা, গল্প, ধাঁধা ও প্রবাদ-প্রবচন সংগ্রহ, সম্পাদনা এবং সংকলন আকারে প্রকাশ করছি। তাছাড়া তাদের দেউলী উৎসবসহ বড় বড় উৎসব-পার্বণ ও কৃষ্টি-সংস্কৃতিগুলো পালন ও চর্চায় উদ্বুদ্ধ করছি।’