১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী কলেজের হোস্টেলে ভাষাসৈনিকরা ইট ও কাদা দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করে নাম দিয়েছিলেন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। এর স্থায়িত্ব হয়েছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। রাতভর নির্মাণের পরদিন সকালেই শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ সেই শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়।
এরপর আর এই শহীদ মিনারের গুরুত্ব পায়নি। রাজশাহীর ভাষাসৈনিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এই শহীদ মিনারটিকে দেশের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানালেও আজ পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন ঘটেনি।
ভাষাসৈনিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীতে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের স্থানে পৌনে চার বছর আগে নতুন একটি শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু আজও সেটি সম্পন্ন হয়নি।
রাজশাহীর ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, বরকতসহ কয়েকজন শহীদ হওয়ার খবর রাজশাহীতে এসে পৌঁছায়। তখন আন্দোলনরত ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয়, রাতেই হোস্টেল এলাকায় শহীদ মিনার তৈরির।
‘যেই কথা তেমনই কাজ। সারা রাত ধরে ইট ও কাদা দিয়ে তৈরি করা হয় দেশের প্রথম শহীদ মিনার। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সেটি ভেঙে দেয়। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজশাহী কলেজ ছিল এ অঞ্চলের একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।’
শহীদ মিনার তৈরির স্মৃতিচারণ করে ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি আরও বলেন, ‘আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা বিভিন্ন স্থান থেকে ইট সংগ্রহ করে। রাতে সিমেন্ট সংগ্রহ করতে না পারায় ইট ও কাদামাটি দিয়ে তারা শহীদ মিনার নির্মাণ করে নাম দেয় শহীদ ম্মৃতিস্তম্ভ।’
রাজশাহীতে নির্মাণাধীন শহীদ মিনার
তিনি আরও বলেন, ‘‘স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লেখা হয়, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ এই কাজে কলেজের কয়েকজন কর্মচারীও সহায়তা করেন। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শেষে ছাত্ররা তার ছবি তুলে রাখে।’’
রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা জাতীয় সংসদেও এটির স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন কয়েকবার। কয়েক দফা সংসদে বক্তব্য দিলেও আজও জোটেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
তবে ভাষাসৈনিক ও রাজশাহীর মানুষের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার সহায়তায় মুসলিম হোস্টেলের গেটের কাছে ২০০৯ সালে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির সেই স্থানটিতে একটি ফলক নির্মাণ করা হয়।
ওই স্থানে একটি শহীদ মিনার স্থাপনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা সেই শহীদ মিনারের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটি আমাদের রাজশাহীবাসীর ব্যর্থতা। এই শহীদ মিনারটি কেন্দ্রের (ঢাকা) বাইরে হওয়ায় স্বীকৃতি না পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। এটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক এটিই আমরা চাই। অন্তত রাজশাহীবাসীর দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হোক।’
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, সাবেরা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শহীদ মিনার নির্মাণের কাজটি পায়। এর জন্য ৫০ লাখ টাকাও বরাদ্দ করা হয়। ২০২০ সালের ৩০ জুন কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই শহীদ মিনারের পাইলিং শেষ হয়েছে মাত্র। এখন কাজ বন্ধ রয়েছে।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক বলেন, ‘শহীদ মিনারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর কিছুদিন কাজ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু কাজটি সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে, তাই সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবে।’
রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহা. হবিবুর রহমান বলেন, ‘নতুন এই শহীদ মিনারের জন্য আমি জায়গা ছেড়ে হোস্টেলের রাস্তা করেছিলাম। শহীদ মিনারের দৃশ্যটা যেন সুন্দর হয়, এক নজরে সবার চোখে পড়ে, এ জন্য পাশের ডাইনিংটাও অন্যত্র সরিয়ে নিলাম। কিন্তু কাজ যতটুকু হয়েছে, তা মাটির নিচেই।’
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটি আমাদের রাজশাহীবাসীর ব্যর্থতা। এই শহীদ মিনারটি কেন্দ্রের (ঢাকা) বাইরে হওয়ায় স্বীকৃতি না পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। এটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক এটিই আমরা চাই। অন্তত রাজশাহীবাসীর দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হোক।’
শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাবেরা এন্টারপ্রাইজের মালিক জুলফিকার হায়দার বলেন, ‘ওই শহীদ মিনারের জন্য মাটির নিচে ২২টি পাইলিং করা হয়েছে। পাইলিং করার পর তিনি সিটি করপোরেশনে বিল দাখিল করেছিলেন। সেই বিল পরিশোধ করা হয়নি। টাকা না পাওয়ায় তিনি ওপরের অংশের কাজে হাত দিতে পারেননি।’
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, ‘ওই সময় ঠিকাদার টাকা পাননি এটা জানি। তবে কেন পাননি এটি তখনকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘নতুন করে শহীদ মিনারটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। নতুন প্রকল্পের মধ্যে এই শহীদ মিনারটিও রাখা হবে। তবে কবে নাগাদ এটি হতে পারে, সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।’