অমর একুশের চেতনায় বাঙালি জাতি প্রতি বছর একুশ ফেব্রুয়ারি ফুল হাতে নিয়ে খালি পায়ে প্রভাতফেরি করে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে হাজির হন।
প্রতি বছর সারা দেশ এ কর্মসূচি পালন করলেও কখনও এ আয়োজন করা হয়ে ওঠেনি ঠাকুরগাঁওয়ের আকচা গ্রামের সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের। গ্রামটি উপজেলা সদরের ৩ নম্বর আকচা ইউনিয়নে।
তবে এ বছর গ্রামের নবগঠিত সামাজিক সংগঠন আকচা তরুণ শক্তির (আতশ) উদ্যোগে বাঁশের নির্মিত শহীদ মিনারে প্রথমবারের মতো ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানালেন গ্রামের মানুষ। বাদ পড়েননি কৃষক ৬৫ বছরের মুহম্মদ ইসলামও। এর আগে ফুল হাতে প্রভাতফেরিতেও অংশ নেন তিনি।
প্রথমবার শহীদ মিনারে এসে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর অনুভূতি প্রকাশ করেন ইসলাম। যে ভাষায় কথা বলি, সন্তানদের মুখে বাবা ডাক শুনি, সেই ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ কখনও হয়নি তার।
তিনি বলেন, ‘আগে কখনও বাইরে ফুল দিতে যাইনি। গ্রামে কোনো শহীদ মিনারও নেই। তাই দূরে কোনো শহীদ মিনারে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েও কেউ নিয়ে যায়নি। এ বছর গ্রামের ছেলেরা একুশের চেতনা বিকাশে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা আমার জীবনের অনন্য এক তৃপ্তি।’
প্রথমবার শহীদ মিনারে এসেছেন দিনমজুর হাসেন আলীও। ঠান্ডাজনিত রোগে ভুগছেন তিনি। অসুস্থ শরীর নিয়েও খালি পায়ে প্রভাতফেরি করেছেন।
তিনি বলেন, ‘খুব ইচ্ছা করত শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিতে। গ্রামে এই প্রথম বাঁশের তৈরি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। ঘরে শুয়ে থাকতে পারিনি। মনের জোরে চলে এসেছি। খুব গর্ববোধ করছি আজ।
‘আজ আমিও গেয়েছি- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’
শুধু এ দুজনই নন, প্রথমবারের মতো শহীদ মিনারে ফুল দিতে পেরে খুশি গ্রামের সবাই। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, শিশু, বৃদ্ধ সবাই প্রথমে প্রভাতফেরি ও পরে শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছেন।
শিশুসহ আকচা গ্রামের নানা বয়সের মানুষ প্রভাতফেরিতে অংশ নেন। ছবি: নিউজবাংলা
স্থানীয় শারমিন ইসলাম বলেন, ‘আজ গ্রামের যে স্কুলটিতে কৃত্রিম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে, সেটির নাম শামসিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখান থেকে আমার পড়াশোনা শেষ হয়েছে অনেক বছর আগে।
‘আশপাশের পাঁচটি মহল্লার ছাত্রছাত্রী এই বিদ্যালয়েই পড়াশোনা করেছি। কিন্তু এতদিনেও কেন স্কুলটিতে শহীদ মিনার নির্মাণ হয়নি তা বোধগম্য নয়। একটি শহীদ মিনার থাকলে অমর একুশের চেতনা অনেক আগেই এখানে বিকশিত হতো।’
সংগঠন আকচা তরুণ শক্তির সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক জানান, এ গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষ শুধু সাক্ষরজ্ঞান অর্জন করেছেন, যাদের অনেকেই কোনো দিন শহীদ মিনারে যাননি।
তিনি বলেন, ‘এ মানুষগুলো দিনমজুর। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের উৎসাহ পেয়েই গ্রামবাসী ও সংগঠনের সবার সহযোগিতায় বাঁশ দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করেছি। মূলত তাদের আগ্রহে ও গ্রামের শিশুদের মধ্যে একুশের চেতনা প্রজ্বলিত করতে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
‘আমরা চাই, গ্রামের সব বয়সী ও পেশার মানুষের মধ্যে দেশের মাতৃভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে।’