ভাষাশহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্র হলেও তার স্মৃতি রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। ক্যাম্পাসে তার স্মৃতি শুধু একটি ভবনের নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
রফিকের নামে নেই কোনো স্মৃতিস্তম্ভ, ভাস্কর্য বা স্মৃতি জাদুঘর। এমনকি রফিকের জন্ম ও শাহাদাতবার্ষিকীতে হয় না আলাদা করে স্মরণসভা।
ভাষা আন্দোলনের সময় রফিকউদ্দিন আহমদ জগন্নাথ কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জের সিংগাইরের পারিল বলধারা গ্রামে (বতর্মানে রফিকনগর) আবদুল লতিফ মিয়া এবং রাফিজা খাতুন দম্পতির ঘরে জন্ম নেন।
বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন রফিক। পরে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়েন। ১৯৫০ সালে সেখান থেকে আইএ পরীক্ষা দিয়ে বাবার প্রিন্টিং ব্যবসা দেখাশোনার জন্য তিনি ঢাকায় চলে আসেন। এরপর জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।
রফিক দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্য বিভাগে পড়ালেখা করেছেন। তিনি জগন্নাথ কলেজের অনিয়মিত অর্থাৎ সান্ধ্যকালীন কোর্সের ছাত্র ছিলেন বলে জানা যায়। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি মাঝে-মধ্যে বাবার প্রেসের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। সে কারণেই ভর্তি হয়েছিলেন সান্ধ্যকালীন কোর্সে।
ওই সময় শুরু হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন। এ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন রফিক, কিন্তু দিন কয়েক পরই পানু বিবির সঙ্গে রফিকের বিয়ে হয়। তাই ছেলেকে মিছিলে যেতে মানা করেন বাবা লতিফ মিয়া।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বিয়ের শাড়ি-গয়না নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার কথা ছিল রফিকের, কিন্তু বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জগন্নাথ কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলে যান তিনি। সেই মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে গুলি চালায় পুলিশ। এতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রফিকের।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্ব দিকে তার মরদেহ পড়ে ছিল। ছয়-সাত জন ধরাধরি করে তার মরদেহ এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন। তাদের মাঝে ডা. মশাররফুর রহমান খান গুলিতে ছিটকে পড়া রফিকের মগজ হাতে করে নিয়ে যান।
জনরোষের ভয়ে ওই দিন রাত ৩টায় সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে রফিকের মরদেহ দাফন করে পাকিস্তান সরকার। সেই কবরের কোনো চিহ্ন রাখা হয়নি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক আবু সালেহ সেকেন্দারের ‘ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে শহীদ রফিকের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার শহীদ রফিককে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। সরকারিভাবে ২০০৬ সালে তার ‘পারিল’ গ্রামে শহীদ রফিকের নামে ‘ভাষা শহীদ পাঠাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ স্থাপন করা হয়। সেখানে তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও প্রচুর বই আছে। তারও আগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার উদ্যোগে তার বাড়ির কাছেই একটি ছোট লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়।
২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে পুরোনো বিজনেস স্টাডিজ ভবনের নাম পরিবর্তন করে ‘ভাষাশহীদ রফিক ভবন’ নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে বাংলা আর ইতিহাস বিভাগের কার্যালয় ও মেডিক্যাল সেন্টারও রয়েছে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্মৃতি রক্ষার্থে নেই কোনো ভাস্কর্য বা স্মৃতিস্তম্ভ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিউজবাংলাকে বলেন, অনেক শিক্ষার্থী হয়তো জানেন না ভাষাশহীদ রফিকের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টতা। তাই তার ভাস্কর্য নির্মাণের দাবি জানান তারা।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রিদুয়ান ইসলাম বলেন, ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের কোনো আবাসিক হল নির্মাণ হলে তা ভাষাশহীদ রফিকের নামে নামকরণ করা যেতে পারে। তার নামে পাঠাগার ও স্মৃতি জাদুঘর স্থাপন করা উচিত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নতুন ক্যাম্পাস তৈরি হচ্ছে, সেখানে শহীদ রফিকের একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা যেতে পারে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শহীদ রফিকের পরিবারকে উপযুক্ত সম্মানে ভূষিত করা হোক।
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিদ ফাইয়াজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি নয়, সারা বছরই যেন এ ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান দেখানো হয়। তাকে নিয়ে বছরের বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠান কিংবা নাটক মঞ্চস্থ করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’
ভাষাশহীদ রফিক স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক রকি আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ভাষাশহীদের স্মৃতিতে জবিতে একটি ভবনের নাম ছাড়া আর কিছুই নেই। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘরসহ নানা উদ্যোগ রয়েছে। তাই আমরা গত বছর ভাষাশহীদ রফিক স্মৃতি পরিষদ গঠন করি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার একটি স্মৃতিস্তম্ভ ও স্মৃতি জাদুঘর স্থাপনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা স্মারকলিপি দিব। তার স্মৃতিতে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
‘ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি প্রতিযোগিতা চলমান। ভাষা আন্দোলনের ওপর লাইব্রেরি ও গবেষণা কার্যক্রম করা যায় কি না, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।'
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শহীদ রফিকের স্মৃতি শুধু ভবনের নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। তার স্মৃতি রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বা ভাস্কর্য বানালে সবার কাছে ইতিহাস রক্ষিত হবে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শহীদ শিক্ষকসহ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষারও উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’