ঘড়িতে রাত ১০টা বেজে ১৫ মিনিট। ঢাকার পান্থপথ কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস। রাঙ্গামাটিগামী বাসটি ছাড়তে তখনও মিনিট পনেরো বাকি। যাত্রীরা বাসে উঠে যে যার আসনে বসছেন। বাড়ি ফেরার আনন্দ নিয়ে বাসে উঠলেন রাঙ্গামাটির মেয়ে সাজিয়া জাহান।
উচ্চশিক্ষার জন্যই ঢাকায় এসেছেন সাজিয়া। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন; থাকেন ইস্কাটনে। গাড়িতে উঠতেই পরিচিত আরেক তরুণী বলে উঠলেন, ‘তুই হন্ডে যদ্দে? বালা আছছ না তুই (তুই কই যাচ্ছিস? ভালো আছিস তুই)?’
উত্তরে সাজিয়া বললেন, ‘আফু, আঁই তো বালা আছি। বউত দিন ফর তুঁয়াল্লই দেহা অইলো দে এনা। তুঁই ক্যান আছ (আপু, আমি ভালো আছি। অনেক দিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হলো। তুমি ভালো তো)?’
আরও কয়েক লাইন এগোয় দুজনের আলাপচারিতা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ‘চাটগাঁইয়া’ ভাষায় কথা বলছিলেন তারা।
তাদের আলাপের ফাঁকে বাসের কয়েকজন যাত্রী অবাক দৃষ্টিতে তাকান, আবার কেউ কেউ হেসে ফেলেন। হাসতে হাসতে কী যেন বলে নিজেদের মধ্যে।
সেদিকে খুব একটা কান দেন না সাজিয়া, তবে বিষয়টি তার জন্য বিব্রতকর। আলাপ সংক্ষিপ্ত করে বসে পড়েন নিজের আসনে।
সাজিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমন ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে। পরিবারের কারও ফোন এলে বন্ধুদের সামনে চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলতে গেলেও কটাক্ষের শিকার হতে হয়। শুরুতে অনেক খারাপ লাগত। এখন গা সয়ে গেছে। আবার বন্ধুরাও বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছে।’
সাজিয়ার মতো এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন অনেকেই। বিশেষ করে বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে কটাক্ষ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হতে হয়।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত পটুয়াখালীর ছেলে রাশেদ রহমান অমিত। সরাসরি সম্প্রচার বা প্রতিবেদন তৈরিতে কণ্ঠ রেকর্ডের সময় প্রমিত বাংলায় কথা বলেন, তবে এর বাইরে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য তার।
অমিত বলেন, ‘বন্ধুদের আড্ডায় ভাষার জন্য খোঁচা যে খাইনি, তা কিন্তু নয়, তবে এসব আমি থোড়াই কেয়ার করি। আমার কিছু যায় আসে না; বরং পটুয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেই আমি ভালোবাসি। মনে শান্তি লাগে।’
চাটগাঁইয়া ভাষার মধ্যে মহাপ্রাণ ধ্বনি হারিয়ে যায়। এ ছাড়া ও-কারান্ত আর উ-কারান্ত বর্ণকে আলাদা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। যেমন: ‘বোন’ শোনা যায় ‘বুন’-এর মতো।
নোয়াখালীর অঞ্চলের ভাষার মধ্যে ‘প’-এর উচ্চারণ ‘ফ’-এর মতো শোনায়। আবার ‘পানি’কে তারা বলেন ‘হানি’।
সিলেটি ভাষার দিকে তাকালেও উচ্চারণগত নানা তারতম্য দেখা দেয়। ‘সিলডি বাষা অইল অন্যান্য বাষার চেয়া ফুরাফুরি আলাদা’, যার অর্থ হলো: সিলেটের ভাষা হলো অন্যান্য ভাষার চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন।
আবার কন্যা শব্দটিকে চট্টগ্রামে বলা হয় ‘মাইয়েফোয়া’, সিলেটিরা বলে ‘ফুরি’, বরিশালে বলা হয় ‘ছেমরি’। আর এমন সব শব্দের ভিন্নতা নিয়ে ভাষাকে ব্যঙ্গ করতে প্রচলিত আছে নানা কৌতুক।
অনেকেই ঠাট্টাচ্ছলে বলেন, বাংলা ভাষা সিলেটে গিয়ে আহত হয়, আর নোয়াখালী পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে গিয়ে হয় নিহত।
এটি প্রচলিত কৌতুক হলেও এতে আপত্তি আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকউল্লাহ খানের। তার মতে, আঞ্চলিক ভাষার কারণে উল্টো সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলা।
রফিকউল্লাহ খান বলেন, ‘ভাষা একেকটি অঞ্চলের সংস্কৃতিকে লালন করে। তাদের ভূগোলকে লালন করে। তাদের উচ্চারণের যে সরলতম পদ্ধতি, সেই পদ্ধতিকে লালন করে। আমার মনে হয় কোনো একটি অঞ্চল, অন্য আরেকটি অঞ্চলের ভাষা নিয়ে কৌতুক করতেই পারে। সেটাকে কৌতুকের পর্যায়ে রাখাই ভালো, কিন্তু আমাদের বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি এবং এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা কাঠামো এবং আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার আমার মনে হয় না যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে।’
মুখের বুলি যত বৈচিত্র্যময় হবে, বাংলা ভাষা তত সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. রফিকউল্লাহ খান।
তিনি বলেন, ‘একটা ভাষার মধ্যে অনেকগুলো আঞ্চলিক রূপ সেই ভাষার ধ্বনিগত তাৎপর্যকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।’
তাই আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাসঙ্গিক মনে করেন না এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, ‘যখন আমি গ্রামে যাই, তখন ঢাকা শহরের এবং বাংলাদেশের একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকের ভাষায় কথা বলি না। আমি সেখানে আমার অঞ্চলের প্রিয় মানুষদের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলি।’
আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির পক্ষ নিয়েই কথা বলেছেন কথাসাহিত্যিক শাহনাজ মুন্নী।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে যে মাধুর্য আছে, অবশ্যই আমি মনে করি তার স্বীকৃতি দেয়া উচিত। এটাতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। কারণ সেটা যদি আমার অঞ্চলের ভাষা হয়, সেই ভাষায় যদি আমি কথা বলি, সেটা যদি আমার পরিমণ্ডলের হয়, সেটা নিয়ে লজ্জা পাওয়ারও কিছু নেই, হীনমন্যতায় ভোগারও কিছু নেই।’
আনুষ্ঠানিক কথা বলায় প্রমিত বাংলাকে উৎসাহ দেয়ার পক্ষে এ কথাসাহিত্যিক।
তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষাকে হেয় করার বা দেখার যে প্রবণতা, এই মানসিকতা আমাদের দূর করতে হবে। কারণ প্রতিটা অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা বৈশিষ্ট্য আছে। সেটা থাকবেই। এটা খুব স্বাভাবিক। পৃথিবীর সব দেশের, সব অঞ্চলের ভাষাতেই আঞ্চলিক টান থাকে। এটা মানুষের সহজাত ব্যাপার।’
আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার কারণে কটাক্ষ করা নিয়ে ঘোর আপত্তি আছে তার। ‘কটাক্ষ করা, ব্যঙ্গ করা, খোঁচা দেয়া, লজ্জা দেয়া, কেউ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা মানে তিনি অশিক্ষিত, মূর্খ, অভদ্র এসব ভাবার সুযোগ নেই; বরং এমন মানসিকতা পরিহার করা উচিত এবং প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব থাকা উচিত, সমান মর্যাদা থাকা উচিত।’
সাহিত্যে আঞ্চলিকতা ও কথ্যরূপ
আঞ্চলিকতা শুধু মুখের ভাষাতে আটকে নেই। আঞ্চলিক ভাষায় তৈরি হয়েছে শক্তিশালী সাহিত্যও।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান উদাহরণ হিসেবে সামনে আনেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য ‘নুরলদীনের সারাজীবন’-এর কথা। এই কাব্যনাট্যের জনপ্রিয় সংলাপ ছিল ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তার অর্থ, ওই অঞ্চলের অস্তিত্বকে, আত্মপ্রকাশের কাঠামোকে সেখানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে কোনোভাবে প্রমাণ হয় না আঞ্চলিক ভাষা বাংলা ভাষার জন্য ক্ষতিকর। সেটা বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করছে; বৈচিত্র্যময় করেছে।’
ভাষা ও সাহিত্যের জন্য লোকজীবন, লোকসংস্কৃতি, লোকসংগীতের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের যে লোকসংগীত, সেই লোকসংগীতে কি প্রমিত বাংলা ব্যবহৃত হয়? না তো। কিন্তু আমরা তো সেটা ত্যাগ করিনি। সেটা আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে।’
সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নিয়ে শাহনাজ মুন্নী বলেন, ‘কুষ্টিয়া অঞ্চলের গল্প যদি বলি, তাহলে যদি ওই ভাষায় আমি লিখি, শুধু সংলাপ না, পুরো উপন্যাসও ওই ভাষায় লেখা যায়, লেখা সম্ভব।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি সামনে আনেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান লেখক হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসকে। তিনি বলেন, ‘সেটা তো পুরো আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। একজন নারীর কথ্য ভাষায় লেখা।’
মাহবুব লীলেন পুরো মহাভারতটাই লিখেছেন কথ্যভাষায়। তার বই অভাজনের মহাভারত কথ্যরূপের একটি স্বার্থক উদাহরণ। লেখক বলতে চান, এটি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষা না, এটা আগামীর ভাষা। সেই ভাষাটিকে তিনি এগিয়ে নিতে চান তার লেখনীতে।
তিনি বলেন, ‘আমার কথা হইল, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণগো মিলিত চেষ্টায় বর্তমানে আগামীর বাংলা ভাষাটা তৈরি হইতেছে। সেইটা ধরার চেষ্টা করছি আমি।’
এখন পর্যন্ত মাহবুব লীলেনের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১২, যার মধ্যে ১১টি বই লেখা হয়েছে প্রচলিত বাংলায়। লীলেন বলেন, ‘২০১৫ সালে পয়লা আমি ভাষা বদলাই অভাজনের মহাভারত দিয়া।’
এর পেছনে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার মূল চরিত্রটা হইল, কথা কইতে গিয়া যদি কোনো শব্দ মুখে আটকাইয়া যায় কিংবা চেহারা ভচকাইয়া তার উচ্চারণ করা লাগে, তবে বাঙালি সেই শব্দটা বদলাইয়া ফালায়। দরকার পড়লে নতুন শব্দ বানায়; সুযোগ থাকলে বাইর থাইকা আইনা বাংলার লগে ফিট কইরা দেয়।
‘এই পুস্তকে (অভাজনের মহাভারত) আমি সমস্ত বাঙালি জাতির ভাষা থাইকা যখন যে শব্দ পছন্দ হইছে, সেইটাই নিছি। খালি খেয়াল রাখছি কোথাও আটকায় কি না। চেষ্টা করছি সহজিয়া বাংলায় গল্পগুলান কইতে, যেমনে মহাভারতের গল্পখান কইতে দিলে কইত বাংলার পালাকার কিচ্ছাকার বয়াতি বাউলেরা।’
আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণে নেই উদ্যোগ
আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই বাংলা একাডেমির, তবে আঞ্চলিক ভাষার অভিধানের কলেবর বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে প্রতিষ্ঠানটির।
বাংলা একাডেমির পরিচালক (গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ) মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমার জানা মতে, বাংলা একাডেমির এই ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। মূলত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হওয়ার পরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা এগুলো নিয়ে কিছু কাজ বোধ হয় তারা করছে।’
অবশ্য বাংলা একাডেমি এ বিষয়ে একেবারে নীরব আছে, এমন মনে করতে নারাজ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মোবারক হোসেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমির কাজ নেই, এমনটা নয়। দেশের প্রথম আঞ্চলিক ভাষার অভিধান বাংলা একাডেমি করেছে একবার। আমাদের নতুন একটা উপবিভাগ করা হয়েছে অভিধান ও বিশ্বকোষ। আমরা অবশ্যই ওই কাজের দিকে হাত দেব।’
আঞ্চলিক ভাষা বিপণ্ন হচ্ছে এমনটা মনে করেন না আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) মো. শাফীউল মুজ নবীন।
যদিও অভিবাসন প্রক্রিয়া আর অনুপ্রবেশের কারণে পুরান ঢাকার আদি কুট্টি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।
শাফীউল মুজ নবীন বলেন, ‘ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল। এটি গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায়।’
আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে কেউ গবেষণা করতে চাইলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দুয়ার খোলা বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক।
তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি তহবিল অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। কোনো গবেষক আগ্রহী হলে আমরা তাদের বৃত্তি দেব। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আগ্রহী গবেষকরা আবেদন করতে পারবেন।’
আগামী অর্থবছর থেকে গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছেন শাফীউল মুজ নবীন, তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে সেটা আরও আগেও হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গবেষকদের জন্য বঙ্গবন্ধু গবেষণা ট্রাস্ট ঘোষণা করেছেন। সেই ফান্ড থেকেও গবেষণা খাতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অর্থ পাবে বলে আশা তার।