১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। এ সংগ্রামে পিছিয়ে ছিল না লালমনিরহাটও।
এ জেলার ছাত্র সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন করে। মহান ভাষা আন্দোলনে লালমনিরহাটের যেসব ভাষাসৈনিক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে দুজন জীবিত আছেন।
তারা হলেন আবদুল কাদের ভাসানী ও মো. জহির উদ্দিন আহম্মদ। আর মারা যাওয়া ১০ ভাষাসৈনিক হলেন আশরাফ আলী, ড. শাফিয়া খাতুন, আবদুল কুদ্দুছ, কমরেড শামসুল হক, মনিরুজ্জামান, কমরেড সিরাজুল ইসলাম, মহেন্দ্র নাথ রায়, মোছা. জরিনা বেগম, মোছা. জাহানারা বেগম (দুলু) ও আবিদ আলী।
ভাষাসৈনিক আবদুল কাদের ভাসানী ও মো. জহির উদ্দিন আহম্মদ ১৯৫২ সালে লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। সে সময় তারা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জেলার সভাপতি ছিলেন মো. জহির উদ্দিন আহম্মদ ও সম্পাদক ছিলেন আবদুল কাদের ভাসানী।
আবদুল কাদের ভাসানীর সঙ্গে গল্পের ফাঁকে জানা যায়, ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল সমর্থনে তারাসহ ছাত্র পরিষদের কয়েকজন সদস্য লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এ সময় পুলিশ কারণে-অকারণে তাদের ধরে থানায় আটকে রাখা শুরু করলে বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে গিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। কাদের ভাসানী ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। দেশের ভাষা আর স্বাধীনতায় তার ভূমিকা ছিল অনবদ্য।
ভাষাসৈনিক কাদের এখন লালমনিরহাট উপজেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের হাঁড়িভাঙ্গা (হলদীটারী) ও জহির উদ্দিন নওদাবস গ্রামে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। তাদের শারীরিক অবস্থা এখন ভালো নেই। তাই আফসোসের সুরে জানান, তাদের খোঁজ করেন না কেউ। সরকারিভাবেও পান না কোনো সহযোগিতা।
নিউজবাংলাকে আবদুল কাদের ভাসানী বলেন, ‘এখন কেউ আমাদের তেমন একটা খোঁজ রাখেন না। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি। তেমন চলতেও পারি না। তাই হয়তো আর কেউ খোঁজ করেন না। তবে মাঝেমধ্যে খোঁজ রাখেন লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক, শুধু মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলে।
‘একটি রুটিনমাফিক আমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়। বছরের ফেব্রুয়ারি মাস ছাড়া বাকি ১১ মাসে খোঁজ নেয়ার মতো কেউ থাকেন না।’
তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবেও তেমন কোনো সহযোগিতা পাই না। আর দেশের কোনো ভাষাসৈনিক মুখ ফুটে কিছু চাইতে যাবে না বলে মনে করি। ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ভিত্তিই হলো ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন না হলে আজ দেশও স্বাধীন হতো না। ভাষাসৈনিকদের জন্য সরকার কী করবে বা করবে না সেটা একান্ত সরকারের। তবে ভাষাসৈনিকদের খুঁজে বের করা উচিত।’
ভাষাসৈনিক আবদুল কাদের আরও বলেন, ‘দেশের জন্য যতটুকু পেরেছি, করেছি। দেশের ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখে ছাত্র সমাজ। তাদের রক্তই স্বাধীনতার শপথ। এর জলন্ত উদাহরণ চিকিৎসক মিলন, মতিয়ার, এস আর আসাদসহ অনেকেই।
‘এখন সেই ছাত্র সমাজের ভূমিকা কোথায়? ভাষার তাৎপর্যটা এখনও বুঝলাম না। এখন বাংলা ভাষার মাঝখানে একটু ইংরেজি ঢুকিয়ে দিলে মনে হয় তারা বেশি শিক্ষিত। এতে ভাষাসৈনিক হিসেবে দারুণ কষ্ট লাগে।’
তিনি বলেন, ‘এত মানুষের জীবনের বিনিময়ে ভাষা পেলাম, সেই ভাষার মর্যাদা এখন সীমিত। কেন জানি ভাষার ওপর মানুষের এখন তেমন আগ্রহ নেই। দেশ একটু উন্নত হয়েছে ঠিক, কিন্তু সত্তা হারিয়ে উন্নয়ন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
‘মন চায় মাঠে থাকতে, কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় এখন আর তেমন কোথাও যেতে পারি না। তবে এতটুকু আশা ব্যক্ত করছি, নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষার চর্চা করবে।’