বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে কবি জীবনানন্দ দাসের নামে একটি হল রয়েছে। তবে এই কলেজে পড়েও অনেকে জানেন না এটি কোন হল। এমনকি ওই হলের ছাত্রদেরও যদি প্রশ্ন করা হয়- ‘আপনি কোন হলে থাকেন?’, অকপটে তারা উত্তর দেন- ‘হিন্দু হল’।
মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের ছাত্ররা হলটিতে থাকেন বলেই এমন উত্তর। শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষও এই ছাত্রাবাসকে হিন্দু হল নামে ডাকেন। ছাত্রাবাসটির দেয়ালজুড়েও লেখা ‘হিন্দু হল’!
এই হলের ছাত্র নিখিল মজুমদার বলেন, ‘হলের আসল নাম জানি, কিন্তু সবাই হিন্দু হোস্টেল নামে চিনে বলে আমরাও হিন্দু হোস্টেলই বলি। হতে পারে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীই এই নাম ছড়িয়েছে। আমাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই।’
কবিতার গভীরে যার ব্যাপক বিস্তৃতি, তার নাম ব্যবহারে অনীহা নিয়ে ক্ষুব্ধ জীবনানন্দপ্রেমীরা। তাদের বক্তব্য- জীবনানন্দ তো হিন্দু কবি ছিলেন না। তার কবিতায় কোনো সময়ই সাম্প্রদায়িকতা উঠে আসেনি। তিনি ছিলেন প্রকৃতির কবি। তাহলে নিজ কলেজে কেন কবি সাম্প্রদায়িকতায় বন্দি থাকবেন?
এই ব্রজমোহন কলেজেই একসময় পড়েছেন, এমনকি শিক্ষকতাও করেছেন জীবনানন্দ। অথচ এখানেই তিনি উপেক্ষিত। তার নামে কলেজের একাধিক স্থাপনাকে এখন ভিন্ন নামে ডাকেন এই কলেজেরই শিক্ষার্থীরা।
কবির নামে কলেজের মঞ্চকে বলা হয় ‘মুক্ত মঞ্চ’ আর তার নামে করা চত্বরটিকে শিক্ষার্থীরা বলেন ‘টিজ পয়েন্ট’। কয়েক বছর আগে কলেজের ক্যান্টিনটি ‘জীবনানন্দ ক্যাফেটরিয়া’ নামকরণ হলেও তা কারো মুখেই নেই।
এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের বক্তব্য- শিক্ষকদের কাছ থেকে শুনেই তারা এসব নামে স্থাপনাগুলোকে চিনেছেন।
কবি জীবনানন্দ দাশ চত্বরে বসে অর্থনীতির শিক্ষার্থী নীলিমা জাহানকে প্রশ্ন করা হয়- আপনার পেছনে থাকা ছাত্রাবাসটির নাম কি?তার উত্তর- হিন্দু হোস্টেল।
প্রশ্ন করা হয়- যেখানটিতে বসে আছেন, সেই জায়গাটির নাম কি? উত্তরে নীলিমা বলেন- টিজ পয়েন্ট। আর তার পাশেই থাকা মঞ্চটির নাম বলেন- মুক্ত মঞ্চ।
নীলিমা বলেন, ‘কলেজে ভর্তির পর থেকে এই স্থানগুলোকে ভিন্ন নামেই চিনেছি। যেখানে বসে আছি সেটা যে কবি জীবনানন্দ দাশের নামে তা জেনেছি ভর্তির দুই বছর পর। এই চত্বরে নামকরণের বড় কোনো ফলকও নেই। আমার ধারণা, আমাদের মধ্যে দুষ্ট লোক রয়েছে। যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছে।’
বাংলা বিভাগের আদৃতা ইসলাম বলেন, ‘এসব বিষয়ে কলেজ প্রশাসনের অনেক আগে থেকেই সজাগ থাকা উচিত ছিল। জীবনানন্দ দাশের নিজ কলেজে তাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে কৌশলে।’
নিজ কলেজেই কবিকে এমন অবহেলা ‘উদ্বেগজনক’ বলে মনে করেন আদৃতা। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা শিক্ষার্থী, আমাদের জানতে হবে এবং জানাতে হবে। কলেজ প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের এড়িয়ে চলা উচিত।’
এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘উত্তরণ’ এর সভাপতি জুবায়ের শাহেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করা হলে তারা ঠিকমতো বলতেই পারে না জীবনানন্দ কে। এটা আমাদের কলেজ কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা যে- কবিকে চিনাতে পারছে না।’
উত্তরণ এর পক্ষ থেকে কবির জন্মবার্ষিকীতে জীবনানন্দ দাশ চত্বরে প্রদীপ প্রজ্বালনের আয়োজন করা হয়েছে। তবে কলেজ থেকে কোনো আয়োজন নেই বলে জানান জুবায়ের।
কবিতা পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেন, ‘কবিকে সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আটকে রাখা হচ্ছে। তার নামে করা ছাত্রাবাসটির দেয়ালে দেয়ালে কেন হিন্দু হল লেখা থাকবে? কেনই বা কবির নামে করা মঞ্চটিতে তার কোনো ছবি থাকবে না? কবির নামে মঞ্চটিতে গরু, ঘোড়ার ছবিতে ভরে রাখা হয়েছে। আমরা চাই, জীবনানন্দের নামে করা স্থান বা স্থাপনাগুলোকে সঠিকভাবে ডাকুক সবাই।’
কবি জীবনানন্দ দাশ গবেষক কবি হেনরি স্বপন বলেন, ‘জীবনানন্দ ও নজরুলের জন্মশতবার্ষিকী একই বছর হলেও বাংলাদেশে নজরুল ইসলামকে নিয়ে আয়োজন ছিল, কিন্তু জীবনানন্দকে নিয়ে তেমন কোনো আয়োজন ছিল না। প্রশাসনের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিদের উপস্থিতি রয়েছে। আর নিজ কলেজেই কবির উপেক্ষিত থাকাটা সত্যি কষ্টদায়ক।’
ব্রজমোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবৃত্তি শিল্পী স. ম. ইমানুল হাকিম বলেন, ‘নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে জীবনানন্দ সম্পর্কে। জীবনানন্দকে জানতে হলে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা বাড়াতে হবে শিক্ষার্থীদের মাঝে। ব্রজমোহন কলেজের অমূল্য এই সম্পদকে যেখানে আমাদের মাথায় তুলে রাখা উচিত সেখানে সাহিত্যে অপার বিস্তৃতি থাকা ব্যক্তিটির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীও আমরা ঠিকভাবে পালন করছি না। এমন চলতে থাকলে শিক্ষার্থীরা একটা সময় জীবনানন্দ দাশকেই চিনবে না।’
বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি গাজী নাজমুল হোসেন আকাশ বলেন, ‘কবির স্মৃতি মুছে ফেলতে কম চেষ্টা হয়নি। তার বসত বাড়িটিও এখন আর নেই। দখল নাকি বিক্রি হয়েছে সেটাও পরিষ্কার হওয়া যায়নি।’
ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ ড. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘কবি জীবনানন্দ দাশ আমাদের কলেজের সঙ্গে মিশে আছেন। তার নামে ইতোমধ্যে একটি চত্বর, মঞ্চ, ক্যাফেটেরিয়া ও ছাত্রাবাস রয়েছে। আমিও শুনেছি, এগুলোকে ভিন্ন নামে চিহ্নিত করা হয় বা চিনে থাকে শিক্ষার্থীরা। এটা দুঃখজনক।’
এ বিষয়ে শিগগিরই সব বিভাগে চিঠি দিয়ে শিক্ষার্থীদের অবহিত করার কাজ শুরু করা হবে বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া জীবনানন্দের জন্মদিনে বিশেষ কোনো আয়োজন না থাকার জন্য করোনা মহামারির কথা বলেন অধ্যক্ষ।