বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলার মূল আকর্ষণ মাছ। এর মধ্যে বাগাড় মাছের নামটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে কয়েক শ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম বাগাড় মাছ ছাড়াই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার সকালে বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পূর্বে গাবতলী উপজেলার ইছামতীর তীরে পোড়াদহ এলাকায় মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়।
মেলার ব্যবসায়ীরা জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে এবারের মেলায় বাগাড় মাছ নিয়ে আসেননি তারা।
গত ২৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের এক বিজ্ঞপ্তিতে বাগাড় মাছকে মহাবিপন্ন ঘোষণা করে বলা হয়, ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে অনুষ্ঠেয় পোড়াদহ মেলায় বাগাড় ক্রয়-বিক্রয় বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হলো।
বন্য প্রাণী আইন-২০১২ অনুযায়ী মেলায় বাগাড় ক্রয়-বিক্রয় করা হলে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে বলে জানিয়ে দেয়া হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগের তৎপরতায় এবার বাগাড় মাছ ছাড়াই পোড়াদহ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রায় ১৬ বছর ধরে মেলায় বাগাড় মাছের ব্যবসা করছেন একই উপজেলার মহিষাবান গ্রামের আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, ‘ছোট থেকে মেলা দেখে আসছি। জীবনে এই প্রথম বাগাড় মাছ ছাড়া পোড়াদহ মেলা হলো। কিন্তু সরকার নিয়ম করেছে, এ জন্য মানতে হবেই।’
তিনি জানান, মেলার জন্য রাজশাহীর ব্যবসায়ীরা প্রায় ২০ লাখ টাকার বাগাড় মাছ কিনেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলো আনা সম্ভব হয়নি।
মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, পোড়াদহ মেলায় এক দিনেই কোটি টাকার মাছের ব্যবসা হয়। তবে এবার ব্যবসা কম। এ ছাড়া এবার মাছের দামও তুলনামূলক বেশি।
মেলায় প্রতি কেজি বোয়ালের দাম চাওয়া হয় ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। আইড় মাছ ১৬০০ টাকা কেজি। এ ছাড়া প্রতি কেজি কাতল ৬০০ টাকা, সিলভার কার্প ৫৫০ টাকা, বিগহেড ৫০০ টাকা। অথচ গত বছরও এসব মাছের দাম গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কম ছিল।
এ বিষয়ে রানীর পাড়া গ্রামের আল আমিন বলেন, ‘এবার মেলায় মাছ কম। এ জন্য দামও বেশি। যে মাছ গত বছর প্রতি কেজি ৩০০ টাকা দরে কিনেছিলাম, এবার তা কিনতে হয়েছে ৪৫০ টাকা দরে।
মাছের আড়ত ব্যবসায়ী আবদুল আলিম বলেন, ‘সাধারণত পোড়াদহ মেলায় কয়েক কোটি টাকার মাছের ব্যবসা হয়। কিন্তু এবার এই ব্যবসা অনেক কম। রাজশাহীসহ অন্যান্য জেলার ব্যবসায়ীরা মেলায় আসেইনি।’
ক্রেতারা বলছেন, সরকারি আদেশ মানতে মেলায় এবার বাগাড় মাছ তোলা হয়নি। কিন্তু পোড়াদহে মানুষ আসেই বড় বড় বাগাড় মাছ দেখতে।
এমনি একজন শিবগঞ্জ উপজেলার ভরিয়া গ্রামের রুহুল আমিন। প্রতি বছর পোড়াদহ মেলায় তিনি মাছ কেনেন। এবারও মাছ কিনেছেন মাঝারি সাইজের একটি কাতল মাছ।
তিনি জানান, ‘পোড়াদহে এবার বাগাড় নেই। এতে একটু মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু মেলার আনন্দ বেশ জাঁকজমক লেগেছে।’
মেলায় মাছ কিনে বাড়ি ফিরছেন ক্রেতারা
পোড়াদহ মেলায় মাছ ছাড়া মিষ্টির সুনামও রয়েছে। এ মেলায় হরেক রকমের মিষ্টি নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। এসব মিষ্টির নামও থাকে বাহারি।
মিষ্টির দোকানি আব্দুল মোমিন জানান, এবার সবচেয়ে বড় মিষ্টি ছিল ইলিশ। ওজন প্রায় ১০ কেজি। দাম ধরা হয়েছে প্রতি কেজি ৫০০ টাকা। এ ছাড়া বালিশ মিষ্টি, চমচম, রসগোল্লাও ছিল।
এবারের মেলায় সবচেয়ে বড় মিষ্টি ছিল ইলিশ
মেলা ঘুরে দেখা যায়, শত বছরের পুরোনো এ মেলায় শুধু মাছ ও মিষ্টি নয়, ঘরসংসারের প্রায় সবকিছুই বিক্রি হয়। এর মধ্যে খাট, হাঁড়িপাতিল, বাঁশ ও বেতের ঝুড়ি, ঢেঁকি, কুলা, চেয়ার-টেবিল ও কাঠের দরজা উল্লেখযোগ্য।
মেলার এক পাশে ছিল সারিবদ্ধ পাঁচটি নাগরদোলা। ছিল চরকিও। শিশু থেকে তরুণ বয়সের সবার ভিড় ছিল মেলায়।
মেলার আয়োজক কমিটির সদস্য শহিদুল ইসলাম জানান, ছোট-বড় মিলিয়ে এবার পোড়াদহ মেলায় ৬০০টি দোকান বসেছে। প্রতিবার এমনি হয়।
শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল
নিষেধ অমান্য করে চলল মেলা
মেলার মাঝপথে এক ঘণ্টার মধ্যেই মেলা বন্ধের নির্দেশ দেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই চলে মেলা।
বুধবার বেলা ১১টার দিকে মেলায় উপস্থিত হয়ে ওই নিষেধাজ্ঞা দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সালাহউদ্দিন। এ সময় তার সঙ্গে গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রওনক জাহানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু প্রশাসনের দলটি আধা ঘণ্টা মেলায় অবস্থান করে ফিরে গেলে আবারও আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে মেলা চলে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সালাহউদ্দিন বলেন, ‘বগুড়ায় করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক। এই কারণে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে মেলার অনুমতি দেয়া হয়নি। তাই এক ঘণ্টার মধ্যে দোকানের মালামাল নিয়ে মেলা ত্যাগ করতে বলা হয়।’
জানতে চাইলে গাবতলীর ইউএনও রওনক জাহান বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের কারণে এবার মেলার কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। অনুমতি উপেক্ষা করেই সাধারণ জনগণ এই মেলায় আয়োজন করেছেন। আমরা মেলায় গিয়ে তাদের নিষেধ করেছি।’
মেলার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছর আগে মেলার স্থানটিতে একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। সেখানে একদিন হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। পরে সেখানে আশ্রম তৈরি করেন সন্ন্যাসীরা। একপর্যায়ে স্থানটি পুণ্যস্থানে পরিণত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে।
প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়। ছুটে আসেন দূর-দূরান্তের ভক্তরা। দিন যত যায়, স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। এভাবেই গোড়াপত্তন ঘটে পোড়াদহ মেলার।
মেলাটি এক দিনের জন্য হলেও পরদিনই একই স্থানে বউ মেলাও বসে। এ সময় সাধারণত নারীরা তাদের নানা রকম পণ্য সংগ্রহ করেন।