আনোয়ারা-বাঁশখালী সড়কের সরকার হাট নেমেই বাজারের উত্তরে চোখে পড়বে মাটির তৈরি একটি ঘর। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে পরিত্যক্ত কোনো নিবাস। তবে কাছে যেতেই দূর হবে সে ভ্রম।
ঘরটির পশ্চিম দেয়ালে ঝুলে আছে লাল রঙের ‘চিঠির বাক্স’। কিছুটা বিবর্ণ বাক্সটিতে ধুলোও জমেছে বেশ। পাশেই প্রায় জং ধরা একটি লোহার পাতে লেখা ‘তৈলারদ্বীপ পোস্ট ই-সেন্টার’। প্রতিদিন সকালে পটিয়া থেকে এখানে চিঠি নিয়ে আসেন রানার। একই দিনে সে চিঠিগুলো পৌঁছে যায় প্রেরকের ঠিকানায়।
এই ডাকঘরটির অবস্থান আনোয়ারার বরখাইনে। ৬ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত চিঠি বিলি হয় এই ডাকঘর থেকে। ৪ ফিট বাই ৪ ফিট আয়তনের একটি কক্ষেই চলে দাপ্তরিক কাজ। আছেন দুজন কর্মচারী।
এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল এজেন্ট (ইডিএ) ব্রাঞ্চ পোস্টমাস্টার পদে গত ৪ বছর ধরে দায়িত্বে আছেন মোহাম্মদ আমির হোসেন। আর চিঠি বিলিকারক হিসেবে আছেন মিজানুর রহমান। মাটি আর ধানের তুষের তৈরি দেয়াল আর টিনের চৌচালা এই ডাকঘরে বসেই গত সোমবার কথা হয় ইডিএ মোহাম্মদ আমির হোসেনের সঙ্গে। তার কাছ থেকে জানা যায় মাটির এই ডাকঘরের ইতিহাস।
তিনি জানান, ৫০ বছরের পুরোনো এই ডাকঘর। কাগজে-কলমে এ জায়গার মালিক সাবেক এমপি সারওয়ার জামাল নিজামের পরিবার। ডাকঘরের জন্য তারা মৌখিকভাবে এ ঘরটি ব্যবহার করতে দিয়েছে। ঘরটি তাদের পূর্বপুরুষের। পটিয়া ডাকঘরের অধীনে এটি পরিচালিত হচ্ছে।
পটিয়া ডাকঘর থেকে আসা চিঠি রেজিস্ট্রার খাতায় লিপিবদ্ধ করে প্রেরকের কাছে পৌঁছে দেন বিলিকারক মিজানুর রহমান। তিনি জানান, ব্যক্তিগত চিঠি কেউ পাঠায় না। সরকারি আর চাকরির চিঠিই থাকে প্রতিদিন।
ডাকঘরটির রেজিস্ট্রার খাতার হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে এখানে চিঠি প্রেরণ-প্রাপ্তি সংখ্যা মোট ৯১টি। এর আগের মাসে ছিল ৬১টি।
পোস্টমাস্টার মোহাম্মদ আমির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৭ সালে ই-পোস্ট সেন্টার করা হয় এ ডাকঘরকে। কিন্তু এখানে ই-পোস্ট সেন্টারের কার্যক্রম নেই। কম্পিউটার-প্রিন্টার বরাদ্দ দেয়া হলেও তা এখনও পটিয়া ডাকঘরে পড়ে আছে। মাটির ডাকঘর হিসেবে এর আলাদা পরিচিতি ও আকর্ষণ রয়েছে। তবে দুঃখেরও শেষ নেই।
‘ঘরটির দরজা-জানালাগুলো ঘুণে ধরেছে। সংস্কারের অভাবে ভঙ্গুর প্রায়। এলাকার মাটির ঘর থাকলেও, নেই মাটির কোনো সরকারি অফিস। বলা চলে পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলে এমন দ্বিতীয়টি আর নেই। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। কেবল প্রতি মাসে ১৫ টাকা অফিস খরচ মেলে। তাও চলে যায় কলম আর কাগজ কিনতে।’
এত কিছুর পরেও ঐতিহ্যবাহী এ ডাকঘরের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে মোহাম্মদ আমির হোসেনের। তিনি বলেন, ‘ঝড়-বৃষ্টির দিনে টিনের চালের ফাঁক গলে পানি পড়ে। মাটির দেয়াল ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায়। নিজের রোজগার থেকেই কয়েকবার মেরামত করেছি। এরপরও দুর্দশা কাটে না। এখানের বিদ্যুৎ বিলের টাকাও আমি দিয়ে থাকি।’