ঝিনাইদহ পৌরসভায় ৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কাজের বিপরীতে ৮৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে, ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন পৌরসভার কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে।
এই জালিয়াতি করা হয় অভিনব একটি উপায়ে। ব্যাংক চেকে যেখানে টাকার অঙ্ক লেখা হয়, সেখানে বাম দিকে অনেকটা ফাঁকা রেখে ডান দিকে টাকার অঙ্ক লেখা হতো। মেয়র সই করার পর বাম পাশের সেই ফাঁকা জায়গায় বসানো হয় টাকা।
এভাবে ১০ হাজার টাকার চেক মেয়রের কাছ থেকে সই করে পাশের ফাঁকা জায়গায় বসানো হয় ৪ লাখ টাকা।
পৌরসভার সদ্য বিদায়ী মেয়র যখন বিষয়টি বুঝতে পারেন, ততক্ষণে এই জালিয়াতি হয়ে গেছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছে। তবে ছয় মাসেও সেই প্রতিবেদন জমা পড়েনি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও পৌরসভার অভ্যন্তরীণ অডিট রিপোর্টের তথ্য বলছে, ২০১১ সালের ১ জুন থেকে ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের বিপরীতে এই টাকা তুলে নেয়া হয়। ৩৭টি কাজের বিপরীতে ঝিনাইদহ সোনালী ব্যাংকের ৩১৬ নম্বর অ্যাকাউন্ট ও ঝিনাইদহ জনতা ব্যাংকের ১৪২৫০৩ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে এই টাকা তোলা হয়।
এই চেক জালিয়াতি নিয়ে পৌরসভার সাবেক সচিব আজমল হোসেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন, নির্বাহী প্রকৌশলী কামাল উদ্দীন ও হিসাবরক্ষক মখলেছুর রহমান একে অন্যকে দোষারোপ করছেন।
পৌরসভার সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু চেক জালিয়াতির বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ২০২১ সালের ২৭ জুন তার দপ্তরের ২৯৬ নম্বর স্মারকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁনকে অন্যত্র বদলি ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব (পৌর-১ শাখা) বরাবর চিঠি দেন।
আসাদুজ্জামান চাঁন একাই ১২টি কাজের বিপরীতে তুলেছেন ৩১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়েও তিনি নিজের নামে কাজ দেখিয়ে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৯ টাকার স্থলে অতিরিক্ত ২৮ লাখ টাকা নিয়েছেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আসাদুজ্জামান চাঁন স্টোরকিপার হিসেবে চাকরিতে যোগ দিয়ে পরে প্রধান সহকারী ও পদোন্নতি পেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হন। ২০ বছর একই কর্মস্থলে চাকরি করছেন তিনি। নানা রকমের অনিয়ম ও পৌরসভার চেকের পাতায় টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি করে অবৈধভাবে লাভবান হয়েছেন।
চিঠিতে চাঁনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও অন্যত্র বদলির জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেন সাবেক পৌর মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু।
মিন্টুর চিঠি পাওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন ২০২১ সালের ১২ আগস্ট ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালককে অভিযোগগুলো তদন্ত করে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিবেদন পাঠাতে বলেন।
তবে উপসচিবের চিঠি আসার প্রায় পাঁচ মাস পার হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অভিযোগ আছে, সাবেক সচিব আজমল হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী কামাল উদ্দীন, হিসাবরক্ষক মখলেছুর রহমানসহ অনেকেই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। তারা মেয়রের চোখ ফাঁকি দিয়ে চেক বইয়ের সামনের কিছু অংশ ফাঁকা রেখে পরে টাকার অঙ্ক বসিয়ে নিতেন।
পৌরসভার হিসাব বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সাইদুল করিম মিন্টু মেয়র হওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত আসাদুজ্জামান চাঁন হাটবাজারের আয়কর ও ভ্যাটের টাকা জমা দেননি।
২০১১ সালের ১ জুন পৌরসভার ক্যাশ বইতে জনৈক নওশের আলীর নামে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ করার বিষয়টি লিপিবদ্ধ আছে। অথচ সোনালী ব্যাংকের ৩১৬ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। অতিরিক্ত তোলা হয় ৪ লাখ টাকা।
নওশের ছাড়াও চেক ইস্যু করা হয় আসাদুজ্জামান চাঁন, নির্বাহী প্রকৌশলী কামাল উদ্দীন, স্যানেটারি ইনস্পেক্টর শংকর নন্দী, প্রকৌশলী মুন্সি আবু জাফর, হিসাবরক্ষক মখলেছুর রহমান, দেলোয়ার হোসেন, সাইদুর রহমান, কনজারভেন্সি পরিদর্শক সামছুল আলম, কমিশনার তোফাজ্জেল হোসেন, পানি বিভাগের বিল ক্লার্ক আনোয়ার হোসেন, কমিশনার মতলেব মিয়া, সাহিনা মৌসুমী, কমিশনার সাইফুল ইসলাম মধু, মিঠু ইলেকট্রনিকস, কমিশনার বশির উদ্দীন ও রবিউল ইসলামের নামে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান চাঁন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চেক জালিয়াতি তো আমি করতে পারি না। এটি অ্যাকাউন্ট কর্মকর্তা মকলেছুর রহমান করতে পারেন।’
মকলেছুর রহমান বলেন, ‘সাবেক সচিব আজমল হোসেন, প্রশাসিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন, প্রকৌশলী কামাল উদ্দীন আমাকে দিয়ে জালিয়াতি করাতে বাধ্য করেছেন। তাদের কাছে আমি অসহায় ছিলাম।’
প্রকৌশলী কামাল হোসেন সব ঘটনা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না।’
সাবেক সচিব আজমলের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোনটি ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ঝিনাইদহ পৌরসভার বর্তমান প্রশাসক ও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক দপ্তরের উপপরিচালক ইয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত চলছে, তদন্তের স্বার্থে এখন কোনো বক্তব্য দিতে পারছি না।’