বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কমিউনিটি ক্লিনিক: ইচ্ছে হলে খোলে দরজা, যখনতখন বন্ধ

  •    
  • ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৫:৪০

চিকিৎসা নিতে আসা মরিয়ম বলেন, ‘এখানে এক-দুই টাকা দামের ট্যাবলেট দিয়ে বিদায় করা হয়। বলা হয়, ওষুধ আসে না। তাই অন্য ওষুধ দেয়া যাচ্ছে না। এগুলো বহু আগে থেকেই শুনে আসছি।’

৩১ জানুয়ারি। বেলা ১টা। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের কাঁশর কমিউনিটি ক্লিনিকের দরজায় ঝুলছে বেশ বড়সড়ো একটি তালা।

দরজার সামনে তখনও অপেক্ষায় বেশ কয়েকজন নারী। চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য পরামর্শ নিতে তারা কয়েক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায়। তারা সবাই ত্যক্ত, বিরক্ত।

সংবাদমাধ্যমকর্মীর পরিচয় পেয়েই খুলে ধরলেন অভিযোগের ঝাঁপি।

কথা হয় রোজিনা বেগম নামে আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে। তিনি চার মাস বয়সী মেয়ে হাবিবাকে নিয়ে এসেছিলেন। জানান, এর আগেও একদিন বেলা ২টার দিকে এসেও তালা ঝুলতে দেখেছেন ক্লিনিকটিতে।

তিনি বলেন, ‘এইহানে সেবা নামেমাত্র। হেরা ইচ্ছামতো আয়ে, ইচ্ছামতো যায়।’

শিশুবাচ্চা কোলে নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মরিয়ম আক্তার নামে একজন। তিনি তার পাঁচ মাস বয়সী মেয়ে রিয়া মনির টিকা কার্ডের জন্য এসেছিলেন। অপেক্ষা করে ফিরে যাচ্ছিলেন। জানান, টিকা কার্ডের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো ঘুরে যেতে হচ্ছে তাকে।

জানালেন, আগেরবার যখন ক্লিনিকটিতে আসেন, সেদিন কার্ডের খরচ বাবদ তার কাছ থেকে ২০০ টাকা চাওয়া হয়েছে, যেটা বিনা মূল্যে দেয়ার কথা। বলেন, ‘সবাই টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছে। ক্লিনিকে এগুলো এখন সাধারণ চিত্র।’

সকাল ৯টায় খোলার কথা থাকলেও কোনো ক্লিনিক খোলে বেলা ১১টায়, কোনোটি ১২টায়, কোনোটি দুপুরের পর, কোনোটি আবার ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ থাকে দিনভর।

মরিয়ম জানালেন, ‘এখানে এক-দুই টাকা দামের ট্যাবলেট দিয়ে বিদায় করা হয়। বলা হয়, ওষুধ আসে না। তাই অন্য ওষুধ দেয়া যাচ্ছে না। এগুলো বহু আগে থেকেই শুনে আসছি।’

এমাতুল রহমত উল্লাহ, রুহুল আমিন ও ফয়জুল হক নামে স্থানীয় আরও কয়েকজনের কাছ থেকেও পাওয়া গেল নানা অভিযোগ। জানান, কেবল এই ক্লিনিক নয়, উপজেলার বেশির ভাগ কমিউনিটি ক্লিনিকেই একই ধরনের চিত্র।

সকাল ৯টায় খোলার কথা থাকলেও কোনো ক্লিনিক খোলে বেলা ১১টায়, কোনোটি ১২টায়, কোনোটি দুপুরের পর, কোনোটি আবার ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ থাকে দিনভর।

আবার খোলা হলে কতক্ষণ চলবে, তারও নেই ঠিকঠিকানা। কখনও এক ঘণ্টা, কখনও দুই ঘণ্টা পরেই বন্ধ করে দেয়া হয়। রোগীরা জানতে চাইলে জরুরি বৈঠক বা অসুস্থতার ছুটির অজুহাত দেন কর্মীরা।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে কথা হয় হবিরবাড়ী ইউনিয়নের কাঁশর কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিবার কল্যাণ সহকারী রাফেজা খাতুনের সঙ্গে। তিনি কোনো অভিযোগই স্বীকার করতে চাননি। তিনি বলেন, ‘কে, কারা এমন মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ তোলে জানি না। অন্যরা ক্লিনিকে নিয়মিত আসেন কি না আমার জানা নেই। তবে আমি যথাসময়ে ক্লিনিকে আসি। সোমবার আমি অসুস্থ থাকায় কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়ে আবার চলে এসেছি।’

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে আসার পর এসব ক্লিনিক বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে ফেরার পর ক্লিনিকগুলো আবার চালু করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এই উদ্যোগে।

টিকা কার্ডের জন্য ২০০ টাকা চাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সহকারী আবু নঈম মামুন একে ‘মিথ্যা’ দাবি করে বলেন, ‘কারও কাছ থেকে টাকা নিলে অবশ্যই ভাউচার দিয়ে থাকি। আমি এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই।’

উপজেলায় মোট ৪৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজননস্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনাসেবা, টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি, স্বাস্থ্যশিক্ষা, পরামর্শসহ বিভিন্ন সেবা দেয়ার কথা।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এসব ক্লিনিক চালু করা হয় তৃণমূলের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার লক্ষ্যে। এর আগ পর্যন্ত গ্রাম এলাকার মানুষ কবিরাজি চিকিৎসা বা অপ্রমাণিত নানা ‍বিষয়ের ওপর নির্ভর করত।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে আসার পর এসব ক্লিনিক বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে ফেরার পর ক্লিনিকগুলো আবার চালু করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এই উদ্যোগে।

ক্লিনিকগুলোয় ২৭ ধরনের ওষুধ বিনা মূল্যে দেয়ার কথা। সার্ভিস প্রোভাইডর, পরিবার পরিকল্পনা সহকারী, অফিস সহকারীসহ তিন-চারজন কর্মরত থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই আছে কাগজে-কলমে। বরাদ্দ থাকলেও ওষুধ কোথায় যায়, কর্মীরা কী করেন, সেসব নিয়ে প্রশ্ন আছে।

সরকারি তদন্তেও উঠে এসেছে অনিয়ম আর সেবা না দেয়ার অভিযোগের বিষয়টি।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা বলছে, সারা দেশে ১৩ হাজার ৮৮১ ক্লিনিকে ২৭ ধরনের দরকারি ওষুধ বিনা মূল্যে দেয়ার কথা থাকলেও এগুলোর বেশির ভাগই পাওয়া যায় না। প্রায় ৮৫ শতাংশ রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে ছুটতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে। এ ছাড়া এসব রোগীকে ওষুধের ৬৪ শতাংশ ব্যয় নিজেদেরই বহন করতে হয়।

গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, গ্রামপর্যায়ে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা যথাযথ কার্যকর নয়। শহর এলাকায়ও পর্যাপ্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেই। এ কারণে রোগীরা চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হন।

ভালুকা কমিউনিটি ক্লিনিকের অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসানুল হোসেন দেন গতানুগতিক জবাব। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ক্লিনিকগুলোয় ২৭ প্রকারের ওষুধ সরবরাহ হচ্ছে। এগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী রোগীদের সরবরাহ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণ পেলেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগেও বিভিন্ন ক্লিনিকে অনিয়মের তথ্য আমাদের কানে এসেছে। কর্মকর্তাদের বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। অসময়ে ক্লিনিকে আসা কিংবা অসময়ে তালা ঝোলানো, অবৈধভাবে টাকা নেয়াসহ কোনো ধরনের ওষুধ বিক্রি করার বিষয়গুলো তদারক করতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’

এ বিভাগের আরো খবর