আগুনে পুড়ে গেছে শরীরের প্রায় ৬০ ভাগ। স্বাভাবিক জীবন হয়েছে সংকুচিত, এরপরেরও অদম্য মনোবলে চাকরির পরীক্ষায় প্রথম হয়ে কাজ শুরু করেন জান্নাতুল ফেরদৌস। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধী এই তরুণীকে ‘স্বাভাবিক কর্মক্ষমতায় ঘাটতির’ কারণ দেখিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে চাকরিচ্যুত করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা খ্রিষ্টান ব্লাইন্ড মিশন (সিবিএম)।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তদন্তেও জান্নাতুলকে চাকরিচ্যুত করার ক্ষেত্রে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মানবাধিকার কমিশন বলছে, এ ঘটনা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর পরিষ্কার লঙ্ঘন।
জান্নাতুল ফেরদৌসের অভিযোগ তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতিহিংসার শিকার। ‘বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনৈতিক অবদান’ নিয়ে ভিডিওচিত্র তৈরির পর তিনি অফিসের লাইনম্যান সাজ্জাত হোসেনের রোষাণলে পড়েন। সাজ্জাতের সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শগত মিল না থাকায় শেষপর্যন্ত তাকে চাকরি হারাতে হয়।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছে খ্রিষ্টান ব্লাইন্ড মিশন। তাদের দাবি, কেবল ‘অদক্ষতার’ কারণেই জান্নাতুলকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
যেভাবে চাকরি হারান জান্নাতুল
আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা খ্রিষ্টান ব্লাইন্ড মিশনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংরক্ষিত পদে প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে ‘ডিসঅ্যাবিলিটি ইনক্লুসন কো-অর্ডিনেটর’ পদে ২০২০ সালের আগস্টে নিয়োগ পান জান্নাতুল ফেরদৌস। রোহিঙ্গা রেসপন্স প্রোগ্রামে চাকরি পেয়ে ওই বছরের ডিসেম্বরে কক্সবাজারে যান তিনি। সেখান তিন সহকর্মীর সঙ্গে শুরু হয় চাকরিজীবন।
তবে ২০২১ সালের ৪ মে প্রতিবন্ধী এই নারীর প্রবেশনাল দক্ষতার প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পদের জন্য জান্নাতুল ফেরদৌস ‘অযোগ্য’। তাকে পদাবনতি অথবা চাকরিচ্যুতির সুপারিশ করা হয়। এরপর গত ১৭ মে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
জান্নাতুলের দাবি, তার বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুদানে ‘বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনৈতিক অবদান’ বিষয়ে খণ্ড ভিডিওচিত্র নির্মাণ করার পরই আমার উপর খড়গ নেমে আসে।”
জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, খণ্ডচিত্রটি মঞ্জুরি কমিটির অনুমোদনের পর এখন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এই কাজের বিষয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার পরপরই তার তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তা (লাইন ম্যানেজার) এনজিওটির ইনক্লুসিভ রোহিঙ্গা রেসপন্স ম্যানেজার সাজ্জাত হোসেন ক্ষুব্ধ হন।
জান্নাতুল বলেন, ‘সাজ্জাত হোসেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী। ছাত্র অবস্থায় তিনি ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর ওপর ভিডিওচিত্র করার পরই আমার বিষয়ে অদক্ষতার অভিযোগ সামনে আনা হয় এবং পরে চাকরিচ্যুত করা হয়।’
জান্নাতুল বলেন, ‘ইন্টারভিউতে প্রথম হয়ে আমি চাকরি পেয়েছি। অথচ দেশের প্রথম প্রতিবন্ধী হিসেবে এবং মুজিববর্ষের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যই আমার সঙ্গে এ অন্যায় করা হয়েছে। এনজিও কর্তৃপক্ষ এটা ইচ্ছাকৃত ভাবে করেছে।’
মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে অনিয়মের প্রমাণ
জান্নাতুলকে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ পেয়ে বিষয়টির তদন্ত করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। গত বছরের ২৩ নভেম্বর চূড়ান্ত করা কমিশনের প্রতিবেদনে একটি অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা।
এতে বলা হয়, ‘জান্নাতুল ফেরদৌসের লাইন ম্যানেজার সাজ্জাত হোসেনসহ সিবিএমে কর্মরত হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড অ্যাডমিন ম্যানেজার মো. আবু জাহিদ ও কান্ট্রি ডিরেক্টর মুহম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা অন্য সুস্থ নারী কর্মীর মতো তার (জান্নাতুল) কাছে কর্মদক্ষতা প্রত্যাশা করেন। একজন সুস্থ ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীর কর্মদক্ষতা ভিন্ন হতে পারে।
‘একজন প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে তার কর্মদক্ষতা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে লাইন ম্যানেজারের রূঢ় আচরণ প্রতিফলিত হয়েছে। এছাড়া শুনানি চলাকালীন সময়ে রূঢ় আচরণের বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে।’
এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘অভিযোগকারীর (জান্নাতুল ফেরদৌস) বিষয়ে লাইন ম্যানেজারের কাছে কর্মদক্ষতার গোপন প্রতিবেদন দাখিলের ক্ষমতা থাকায় তিনি সেটার পূর্ণ ব্যবহার করে নেতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। তিনি চাইলে এ বিষয়ে আরও সহানুভুতি ও সহনশীল মনোভার পোষণ করে প্রতিবেদন দিয়ে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য গ্রহণযোগ্য ও কর্মপরিবেশ বান্ধব করতে পারতেন।’
প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে আলাদা পরিবেশের প্রয়োজন হলেও সিবিএম-এর উখিয়া উপজেলায় নিজস্ব কোনো অফিস নেই বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ‘তারা (সিবিএম) পার্টনার সংস্থা সিডিডি-এর অফিসে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সিবিএম সংস্থার সুস্থ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল।’
চাকরি থেকে অব্যাহতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সময় সিবিএম কান্ট্রি অফিস কর্তৃপক্ষ অভিযোগকারী প্রতিবন্ধী নারীর কর্মদক্ষতা যে একজন সুস্থ ব্যক্তির সমান হবে না- সে বিষয়টি বিবেচনা করেনি বলেও মন্তব্য করেছে মানবাধিকার কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অব্যাহতি বিষয়ে সিবিএম কর্তৃপক্ষ কোনো মিটিং করেনি। এমনকি চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কর্তৃপক্ষের ম্যানেজমেন্ট বিভাগ কোনো লিখিত ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করেনি।
‘কেপিও রিপোর্টে জান্নাতুলের কর্মদক্ষতা সংক্রান্ত মতামত ব্যাখ্যাসহ তাকে পদের নিম্নধাপে পদাবনতি দেয়া বা অব্যাহতির সুপারিশ করা হলে সিবিএম কর্তৃপক্ষ অদৃশ্য কারণে গুরুদণ্ড বা অব্যাহতির সুপারিশ গ্রহণ করেন। কর্তৃপক্ষ চাইলে পদাবনতির সুপারিশটিও গ্রহণ করতে পারতেন। এতে এটা প্রমাণিত অভিযুক্তরা অভিযোগকারীকে কোনোক্রমে সিবিএমে কর্মরত রাখার পক্ষে ছিল না।’
মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সুরক্ষায় গঠিত জেলা কমিটির বা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক মাধ্যমে সুরাহা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে আগামী ২৩ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রতিবেদন দিতেও বলেছে কমিশন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের বিচারকাজ চলছে। প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে জান্নাতুল যেন ন্যায়বিচার পান সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।’
জেলা প্রশাসকের তদন্তেও বৈষম্যের প্রমাণ
অভিযোগকারী জান্নাতুল ফেরদৌস ও তার লাইন ম্যানেজার সাজ্জাত হোসেনসহ সিবিএম-এর হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড অ্যাডমিন ম্যানেজার মো. আবু জাহিদ ও কান্ট্রি ডিরেক্টর মুহম্মদ মুশফিকুল ওয়ারাকে নিয়ে এরই মধ্যে তিন দফা শুনানি করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয় সব শেষ শুনানি করে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। এ সংক্রান্ত পর্যালোচনা প্রতিবেদনে জান্নাতুল ফেরদৌস বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, একজন প্রতিবন্ধী নারীর কাছে তারা (সিবিএম) অন্য সুস্থ নারীর মতো কর্মদক্ষতা প্রত্যাশা করেছেন। যেটি প্রচলিত আইন এবং সংবিধান অনুযায়ী সাংঘর্ষিক। লাইন ম্যানেজার তার সঙ্গে রূঢ় আচরণও করেছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদকে কয়েক দফা ফোন করলেও তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলে বুধবার তিনি ফিরতি বার্তায় জানান, বিষয়টি নিয়ে পরে কথা বলবেন।
জান্নাতুলের তোলা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে খ্রিষ্টান ব্লাইন্ড মিশনের ইনক্লুসিভ রোহিঙ্গা রেসপন্স ম্যানেজার সাজ্জাত হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা বিচারাধীন একটি বিষয়। এজন্য আমি কোনো মন্তব্য করব না।’
অন্যদিকে খ্রিষ্টান ব্লাইন্ড মিশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর মুহম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অদক্ষতার কারণেই তাকে (জান্নাতুল) অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এখানে অন্য কোনো কারণ নেই। চাকরিতে যোগদানের পর ছয় মাসের প্রবেশনকালে তিনি কাঙিক্ষত পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি। পরে তাকে আরও তিন মাস সময় দেয়া হয়, তারপরও তিনি সেভাবে কাজ করতে পারেননি। এজন্য সব নিয়ম নীতি মেনে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।’