করোনা ও অগ্নিকাণ্ডের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা কম নয় নারায়ণগঞ্জে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা-সিলেট ও এশিয়ান হাইওয়ে সড়কে দুর্ঘটনায় গত এক বছরে নারী, শিশুসহ ১২৭ জন প্রাণ হারিয়েছে।
এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন সড়কে মৃত্যু হয়েছে আরও ২২ জনের।
করোনায় এই জেলায় গত দুই বছরে ৩২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিস্ফোরণ ও আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন নারী, শিশুসহ ১১৮ জন।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের এই তালিকা তৈরি করেছে হাইওয়ে পুলিশ।
তালিকায় বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে মেঘনা ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে পুরিন্দা বাজার এবং এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের মদনপুর থেকে কাঞ্চন এলাকা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের অংশে ১৩১টি বড় দুর্ঘটনায় নারী শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া যাত্রী ও পথচারীসহ আরও অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ করিম খান নিউজবাংলাকে জানান, তিনটি মহাসড়কে যানবাহনের বেপরোয়া গতি রোধে হাইওয়ে পুলিশের টহল থাকে। তবুও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।
ওসি জানান, ২০২১ সালে তিনটি মহাসড়কে ছোট-বড় মিলিয়ে আড়াই শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩১টি বড় দুর্ঘটনায় ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
তিনি জানান, বেপরোয়া গতির যানবাহন, যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ যান, মোটরসাইকেল চালকের অসাবধানতা ও পথচারীর অসচেতনার কারণে দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। এসব সমস্য সমাধান হলে দুর্ঘটনা কমে আসতে পারে।
হাইওয়ে পুলিশের ওসি বলেন, ‘সড়কে প্রাণহানির ঘটনায় মামলা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাড়ি ফেলে চালক পালিয়ে যান। আমরা যানটি জব্দ করি, পাশাপাশি চালককে আটকের চেষ্টা করে থাকি। যেসব ঘটনায় চালক ও যান পলাতক থাকে আমরা তাও খুঁজে বের করার কাজ অব্যহত রাখি।’
শুধু মহাসড়ক নয় জেলার বিভিন্ন সড়কগুলোতে ঘটেছে আরও প্রাণহানি। থানা পুলিশের তালিকায় বলা হয়েছে, জেলার বিভিন্ন সড়কে চলতি বছরের ১ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দুর্ঘটনায় আরও ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় জেলার সাতটি থানায় মামলাও রয়েছে। তবে হাসপাতালে বা বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্য নেই পুলিশের কাছে।
জেলার পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম নিউজবাংলাকে জানান, সড়কে চলাচলরত যানবহানের চালকদের সর্তক থাকতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি যাত্রীসহ পথচারীদের সচেতন হতে হবে।
তিনি জানান, দুর্ঘটনা রোধে সড়কগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা কাজ করে থাকেন। প্রয়োজন হলে তাদের পরিসর বৃদ্ধি করা হবে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘থানায় মামলা হওয়ার পর পুলিশ তদন্ত করে থাকে। আমরা চেষ্টা করি ঘটনার সাথে জড়িতকে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি মামলার তদন্তে ঘটনার সব কিছু তুলে ধরার। তবে মামলা দিয়ে তো দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। দুর্ঘটনা রোধে চালক, যাত্রী, পথচারীসহ সকলকে আইন মেনে চলতে হবে।’
সড়ক দুর্ঘটনায় অপমৃত্যু কিংবা সড়ক আইনে মামলার সংখ্যাও কম নয় নারায়ণগঞ্জের আদালতে। দুর্ঘটনার পর পুলিশ ও নিহতের স্বজনরা বাদী হয়ে মামলা করেন সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে।
আদালত পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সড়ক আইনের ১১১টি মামলার নথি আদালতে উঠেছে। ২০২০ সালে ১৪৯ ও ২০১৯ সালে ১১৩টি মামলা আসে আদালতে। ওইসব মামলাগুলোর মধ্যে কিছু মামলার বিচারকাজ শেষ হলেও অনেক মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, ‘করোনাসহ নানা সংকটের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশ মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যেসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা যায় সেসব ঘটনায় আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। আর চালক, হেল্পার ও গাড়ি শনাক্ত করা না গেলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন মামলা তদন্ত কর্মকর্তা।’
রাষ্টপক্ষের আইজীবী বলেন, ‘ঘটনার সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে পুলিশ জড়িতদের আইনের আওতায় আনলে মামলাগুলোতে অভিযোগ দেয়া সম্ভব হয়। এজন্য প্রতিটি সড়ক আইনের মামলায় পুলিশের ভূমিকা মুখ্য।’
‘মামলাগুলোকে তাদের আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন। কারণ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো স্বজন হারিয়ে দোষীদের বিচারের অপেক্ষায় থাকে।’
দোষীদের শাস্তি চেয়ে আসছে বিভিন্ন সংগঠন
সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের মতো দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সংগঠনও। সভা ও মানববন্ধন করছে বছরজুড়ে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নারায়ণগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক ধিমান সাহা জুয়েল জানান, অদক্ষ ও বেপরোয়া গাড়িচালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, যানবাহন চলাচলে অযোগ্য রাস্তা ও জনসচেতনার অভাবে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।
তিনি জানান, সড়কে প্রাণহানির ঘটনার পর মামলা হলেও তদন্ত বেশি দূর গড়ায় না, ফলে যেসব ঘটনায় চালক ধরা পড়ে তাদের আদালতের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। তবে বেশির ভাগ ঘটনায় যানবাহনের চালক পালিয়ে আত্মগোপন করে। মামলা হলেও পুলিশ তাদের ধরতে পারে না। ফলে ওই সব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বিচার না পেয়ে হতাশায় ভোগে।
নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের নারায়ণগঞ্জের সভাপতি ডা. আল ওয়াজেদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ২৮ বছর ধরে মানুষকে সচেতন করাসহ প্রশাসনের কাছে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন দাবি করে আসছি। ঘটনার সঙ্গে জড়িদের শাস্তি দাবি করছি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে।’