বিদেশে বিনিয়োগের দ্বার সম্প্রতি উন্মুক্ত করেছে সরকার। এত দিন রপ্তানি খাতের কিছু প্রতিষ্ঠানকে ‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন রপ্তানিমুখী সব প্রতিষ্ঠানকেই বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলো। এ বিষয়ে একটি বিধিমালা তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা। বলেছেন, এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাড়বে আয়। কমবে দেশ থেকে অর্থপাচার।
সম্ভাবনার মাঝে কিছু ঝুঁকির কথাও বলেছেন তারা। তাদের মতে, বিদেশে বিনিয়োগ সফল হলে তা হবে দেশের জন্য মঙ্গল। কেননা এতে দেশের মধ্যে আয় আসবে।
আর যদি সফল না হয়, তা হলে খারাপ হবে; কারণ বিনিয়োগের টাকা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ব্যয় হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ উদ্যোগকে সমর্থন করে বলেছেন, এতে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, আয়ও আসবে। বাংলাদেশের জনগণই বিদেশে গিয়ে চাকরি পাবে।
রোববার অর্থনৈতিক বিষয়ক ও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অনেকেই সৃজনশীল ধারণা নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগের চেষ্টা করছেন। এটা অন্যায় কিছু না। যদি অনুমতি না দেয়া হয়, তাহলে হুন্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অর্থ চলে যাবে। তার চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়াই ভালো।’
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ, ওষুধ ও পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিশ্বমানের কিছু উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। উদ্যোক্তাদের নতুন প্রজন্ম অনেক সক্ষম ও প্রতিভাবান। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। ভারত ও অন্যান্য দেশ এ সুযোগ নিচ্ছে। আমাদেরও এ বিষয়টাকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দেখা উচিত।’
নতুন বিধি অনুযায়ী, রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রপ্তানির বিপরীতে রিটেশন কোটা হিসেবে বিদেশে মূলধন (ইক্যুইটি) বিনিয়োগ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি তার নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৩ সালে প্রথম একটি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয় সরকার। বর্তমানে দেশের ১৭টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি থাকলেও সবাই বিনিয়োগ করেনি।
তবে বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলছেন, দেশে বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, বিনিয়োগের জন্য বিদেশে পাঠানো অর্থ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা, বিদেশে আয় করা মুনাফা দেশে আনা, টাকা নিয়ে গেলে তা ফেরত আসবে কি না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। তা না হলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত চাপে পড়তে পারে। এই অবস্থায় সরকারের উচিত হবে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এত বেশি হয়ে যায়নি যে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তদারকি কে করবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলে টাকার বিনিময় হারের ওপর প্রভাব পড়ে কি না, সেটাও দেখার বিষয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক বর্তমানে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখি। বর্তমানে বাংলাদেশে করপোরেট সেক্টরে যে বিকাশ হয়েছে, তার সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ। করপোরেশনগুলোকে বড় করতে হলে বিশ্ববাজারে তাদের থাকতে হবে। শুধু পণ্য বিক্রি করে নয়, বিনিয়োগ করতে হবে। পৃথিবীর সব বড় বড় করপোরেট হাউসগুলো তাই করে। বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে।’
তিনি মনে করেন, বিদেশে বিনিযোগের সুযোগ দেয়ার ফলে ঝুঁকির চেয়ে সম্ভাবনাই বেশি। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের সুযোগ দেয়ার ফলে লাভবান হয়েছে তারা। এই সুযোগ দেয়ার ফলে দেশ থেকে অর্থপাচার কমবে। আরও আগে এ সুযোগ দিলে ভালো হতো। তবে বিলম্বে হলেও এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।
সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন গবেষণা পরিচালক বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে, যারা বিদেশে বিনিয়োগ করে আয় করার সামর্থ্য রাখে। এরই মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগ করে আয় করেছে। আফ্রিকার অনেক দেশে বাংলাদেশি গার্মেন্ট শিল্প আছে। সামিট গ্রুপ সিঙ্গাপুর স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত শীর্ষ কোম্পানির মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তান আমলেও নাভানা গ্রুপ আবুধাবিতে কাজ করত। ফলে আমি মনে করি, এ উদ্যোগ দেশের জন্য ইতিবাচক।’
তবে কিছু শঙ্কার কথাও জানান তিনি। বলেন, বিদেশে বিনিয়োগ হলে দেশ থেকে টাকা বের হয়ে যাবে, যেটাকে বলা হয় ক্যাপিটাল আউটফ্লো। বিনিয়োগ যদি লাভজনক না হয়, তা হলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কিছুটা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। যেকোনো ব্যবসায় ঝুঁকি থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকি হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার মজুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়া। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দেখেশুনে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে।’
নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আগেও এ সুযোগ ছিল। এখন একটা বিধির মাধ্যমে আরও সহজ করে দিয়েছে। আমি মনে করি, এটা ভালো উদ্যোগ। ফলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী যাদের বিদেশে বিনিয়োগ করার মতো সামর্থ্য আছে, সহজেই বিনিয়োগের সুযোগ পাবে তারা।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব ব্যবসায় কিছু না কিছু ঝুঁকি থাকে। কোথায় কী ধরনের ঝুঁকি আছে, তা মূল্যায়ন করে বিনিয়োগ করা উচিত। তা হলে ওই বিনিয়োগ টেকসই হবে।’
বিদেশে কোন খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উজবেকিস্তান আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। বিনা মূল্যে জমি দেয়ার কথা বলেছে তারা। ওখানে বিদ্যুৎ-গ্যাস আমাদের চেয়ে আরও সহজলভ্য। সুতরাং সেখানে বিনিয়োগের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারি।
‘এ ছাড়া গার্মেন্টসের পাশাপাশি টেক্সটাইল, পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্পে বিনিয়োগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য সম্ভাব্য গন্তব্যস্থল হতে পারে উজবেকিস্তান।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে আফ্রিকার দেশগুলোতে বিনিয়োগে ঝুঁকি আছে। কিছু বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ইথিওপিয়া, উগান্ডা, মরিশাসে কাজ করলেও ওই সব দেশে কিছু ঝুঁকির শঙ্কা আছে।’