বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নেয়ার পেছনে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তার ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি’র বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার কথা জানিয়েছেন তার এক ব্যক্তিগত চিকিৎসক।
বিএনপি নেত্রীকে আড়াই মাসের বেশি সময় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় নিয়ে যাওয়ার আগে মঙ্গলবার গণমাধ্যমকর্মীদের এ কথা বলেন তার চিকিৎসক ফখরুদ্দীন মোহাম্মদ সিদ্দিকী।
হাসপাতালে ভর্তির ৮১ দিনের মাথায় মঙ্গলবার বিএনপি নেত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাত সাড়ে ৭টায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি হাসপাতাল ছাড়ার আগে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে আসেন তাদের চিকিৎসকরা।
এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার টিউমার অপারেশন করা ছাড়াও রক্তনালির রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে বিশেষ চিকিৎসা দেয়া হয় বলে জানান ফখরুদ্দীন মোহাম্মদ সিদ্দিকী।
যে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে, সেটিকে সাময়িক উল্লেখ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য আবার বিদেশে নেয়া প্রয়োজন বলেও মত দেন এই চিকিৎসক।
খালেদা জিয়াকে কেন বাসায় নেয়া হচ্ছে- এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে চিকিৎসক সিদ্দিকী বলেন, ‘হাসপাতালে উনি যদিও স্ট্যাবল আছেন, এখন দেখতে পাচ্ছি, সারা দেশে এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে করোনার সংক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। শুধু জানুয়ারি মাসে এই হাসপাতালে প্রায় ৩৮০ জন পেশেন্ট, কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং তারা বিভিন্নভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
‘এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ওনার স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে মেডিক্যাল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই মুহূর্তে ওনার কন্ডিশন যেহেতু কিছুটা স্ট্যাবল আছে, ওনাকে বাসায় রেখে আমাদের তত্ত্বাবধানে ওনার চিকিৎসা করা প্রয়োজন। না হলে এই সংক্রমণ যদি আবার কোনো জটিলতা সৃষ্টি করে, তাহলে এর ম্যানেজমেন্টটা জটিল ও কঠিন হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘দুইবার মেজর ব্লিডিং হয়ে ওনার জীবন সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে গিয়েছিল। স্পেসিফিক ব্যবস্থার পর আমরা এখন মনে করছি, ওই ধরনের ম্যাসিভ ব্লিডিং হওয়ার শঙ্কা আপাতদৃষ্টিতে নাই। কিন্তু মেডিক্যাল প্রফেশনে শতভাগ গ্যারান্টি কিছুতেই দেয়া যাবে না।
‘তবে আমরা জানি যে স্মল স্কেলে ব্লিডিং হতে পারে, সেটা বাসায় রেখেও হ্যান্ডেল করা সম্ভব হতে পারে। এ জন্যই আমরা ওনাকে হাসপাতালে রাখলে করোনার যে রিস্ক, তার চেয়ে বাসায় রেখে চিকিৎসা দেয়াটা সেফ মনে করছি। এ জন্যই ওনাকে বাসায় নেয়ার চিন্তাভাবনা করেছি।’
গত বছরের ১৩ নভেম্বর বিকেলে খালেদা জিয়াকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে এভারকেয়ারে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় পরের দিন ভোরে তাকে সিসিইউতে নেয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসা চলছিল তার।
সে সময় বিএনপি নেত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের নেত্রীকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে আবেদন করা হয়। বিএনপিও এই দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, তাদের নেত্রীর জীবন সংকটাপন্ন। তার চিকিৎসকরা দাবি করেন, খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিস হয়েছে এবং এর চিকিৎসা দেশে নেই। দ্রুত বিদেশে পাঠানো না গেলে তার কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপি নেত্রীকে দেখে এসে বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকার বিদেশে না পাঠালে কিছু একটা হয়ে যাবে।
চিকিৎসক সিদ্দিকী আজও বলেন, তারা যে চিকিৎসা করেছেন, সেটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। বিএনপি নেত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
চিকিৎসক সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা অনেকটা ডেসপারেট হয়ে ওনার ব্লিডিংয়ের সোর্সগুলো ব্লক করেছি। আমরা যে প্রসিডিউরটা করেছি, সেটা সাময়িক, তবে ওনার যে মূল অসুখ, সেটি আবার দুই থেকে তিন মাস পর দেখা দিতে পারে।
‘আমাদের যে সাজেশনটা ছিল, হাই প্রেসারের ফ্লোটাকে বাইপাস করে আরেকটা চ্যানেল করতে (টিপস), এটা করতে এক্সেলেন্স লাগে। একটা সেটআপ লাগে। যার-তার কাছে বেগম খালেদা জিয়াকে ছেড়ে দেয়া যাবে না। সে জন্য আমরা কতগুলো নির্দিষ্ট সেন্টারের কথা বলেছিলাম।’
‘সেটি দেশে সম্ভব নয়, বিদেশে নিতে হবে’- এক প্রশ্নের জবাবে বলেন বিএনপি নেত্রীর চিকিৎসক।
কী চিকিৎসা হয়েছে
আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে এই হাসপাতালে খালেদা জিয়ার কী চিকিৎসা হয়েছে, সেটিও তুলে ধরেন তার চিকিৎসায় গঠন করা মেডিক্যাল বোর্ডের এই সদস্য।
তিনি জানান, ১৩ নভেম্বর বিএনপি নেত্রীর খাদ্যনালির ওপরের অংশে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, সেটির চিকিৎসা হয়েছিল ১৪ তারিখে। ৬টা ব্যান্ডিং করা হয়েছিল।
তারপরে ২৩ তারিখে ওনার আবার বড় রকমের রক্তক্ষরণ হয়। সেটি প্রচলিত এন্ডোস্কপ করে বন্ধ করা যায়নি। তখন ‘ক্যাপসুল এন্ডোস্কপ’ নামে একটি যন্ত্র বিদেশ থেকে আনিয়ে ২৪ ডিসেম্বর রক্তক্ষরণের উৎসটা বের করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। গত ৩ জানুয়ারি সেই বিশেষ এন্ডোস্কপি করা হয়।
এরপর আপার চেম্বারে আরও ৫টি ব্যান্ড দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা হয়।
চিকিৎসক সিদ্দিকী বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে মেজর ব্লিডিংয়ের চান্স আপাতত থামানো গেছে। আমরা ওনাকে সিসিইউতে রেখে ৬ দিন অবজার্ভ করি। তখন দেখি ওনার ম্যাসিভ বা স্মল স্কেলে ব্লিডিং হচ্ছে না। তখন ৯ তারিখ ওনাকে শিফট করি, কেবিনে নিয়ে আসি।’
‘সম্পূর্ণ চিকিৎসা হয়নি’
তবে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা এখনও পূর্ণাঙ্গ হয়নি বলেও জানান এই চিকিৎসক। বলেন, ‘একটা কথা সুস্পষ্ট বলে রাখা প্রয়োজন, ওনার মূল যে অসুখ, সেই অসুখের যে কনসিকোয়েন্স, হাইপ্রেসারের পোর্টাল সার্কুলেশন, সেই জন্য যে বাইপাস স্ট্রেইন তৈরি করে দেয়া, সেটা কিন্তু আমরা করতে পারিনি। আমরা যেটা করেছি, সেটা হচ্ছে, দৃশ্যমান বড় যে ভ্যাসেলগুলো ফেটে যাচ্ছিল, সেগুলোকে ব্যান্ডিং করা হয়েছে, কিছু ব্লক করা হয়েছে।’
নভেম্বরের আগের মাসেও খালেদা জিয়া একই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন তার বায়োপসি করে একটি টিউমারের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বলেও জানান চিকিৎসক সিদ্দিকী। সেটি অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু এরপর আরও কিছু চিকিৎসা দিতে হয়, যা দেয়া যায়নি বলেও জানান তিনি।