‘চায়ের দোহানো আইয়া একটা চা অথবা পান খাইয়া বড় বড় নোট দেহাইয়া ফাহি দেওনের দিন শেষ। ভাংতি নাই কইয়া বা ভুলে মানিব্যাগ লগে আনছি না কইয়া গরিবের পাঁচ টেহা মাইরে দেওনের দিন আর নাই। অহন কেউ যদি কয় ভাংতি নাই, সাথে সাথে বিকাশ পেমেন্টের নম্বরটা দেহাইয়া কই, এই নম্বরে দিয়ালাইন।’
চায়ের কাপে চিনি দিয়ে চামচ নাড়ছিলেন আর চা বানাতে বানাতে নিউজবাংলার সঙ্গে এভাবেই কথা বলছিলেন কিশোরগঞ্জ পৌর শহরের পুরান থানা এলাকায় চায়ের দোকানি পূর্ব তারাপাশার বাসিন্দা মিঠু মিয়া।
তিনি বলেন, ‘বাংলালিংকের বেডাইনতে এই সিস্টেমডা চালু করণে আমরার লাগিও ভালা অইছে, কাস্টমারেরও সুবিধা অইছে। অহন অইল ডিজিটাল যুগ, বেহের (সবার) মোবাইলেই বিকাশ আছে। একটা চা বানাইতে দেরি অয়, কিন্তু টেহাডা মোবাইলে আইতে দেরি অয় না।’
গত কয়েক বছরে টাকা আদান-প্রদানে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার বেড়েছে। অনলাইনে ট্রান্সফারের পাশাপাশি মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবার পরিধিও বাড়ছে।
এর বাইরে এখন মুদি দোকানেও ডেবিড ও ক্রেডিট কার্ড নেয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এখন ১০০ টাকার বিলও পরিশোধ করা যায় কার্ডে। ২০২০ সালে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর কাঁচাবাচারে বিকাশ-নগদের মতো সেবা ব্যবহার করে পণ্যের টাকা পরিশোধ করতে দেখা গেছে।
এর মধ্যে আড্ডায়-আলোচনা ওঠে, বিকাশ-নগদ-রকেটের মতো সেবা দিয়ে কোনো একদিন হয়তো রিকশাভাড়া, বাসভাড়া, চায়ের দোকানের বিলও পরিশোধ করা যাবে।
এরই মধ্যে এই ব্যবস্থা চালু করে মিঠু হয়তো জানান দিলেন ভবিষ্যতে এমনটিই হতে যাচ্ছে।
রাস্তার ধারে পিঠার দোকানগুলোতেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিল পরিশোধের সুবিধা থাকছে। ছবি: নিউজবাংলাতিনি বলেন, ‘অনেকের পকেটে ভাংতি টেহা থাকলেও মজা কইরেও বিকাশে দেয়। প্রতিদিন ১০০ টেহার উপরে বিকাশে বিল পাই। আফনেও একটা চা খাইয়া বিকাশে দিয়ালাইন।’
২৪ বছর বয়সী এই যুবক গত মাসে বিকাশ পেমেন্টের এই সেবা চালু করেছেন তার দোকানে। জানান, তার আশপাশের দোকানেও একইভাবে বিল দেয়া যাচ্ছে।
মিঠুর সঙ্গে কথা শেষ করতে না করতেই ডাক দেন রাস্তার উল্টোপাশের দোকানি ঝুটন দাস। তিনি মনোহরি মালামালের পাশাপাশি বিক্রি করেন পান, সিগারেট। নিজেই থেকেই বলছিলেন, বিকাশ পেমেন্ট চালু আছে তার দোকানেও।
ঝুটন বলেন, ‘এই পেমেন্ট সিস্টেমডা আমারে ভাংতির যন্ত্রণা থাইক্যা বাঁচায়া দিছে । একটা পান খাইয়া কাস্টমারে যহন কয় ভাংতি অইবনি, তহন আমরা কই মোবাইলে বিকাশ পেমেন্ট থাকলে ভাংতির চিন্তা করুইন না যে। পানডা খাইয়া টেহাডা এই নাম্বারে দিয়ালাইন।’
মোবাইলে টাকা নিলে নোট ছেঁড়াফাটার সমস্যাও থাকে না বলে জানান এই বিক্রেতা। বলেন, ‘বড় নোটের ক্ষেত্রে ভাংতি সমস্যা থাহে আর বেশির ভাগ ছুডু নোট থাহে ছিঁড়াফাড়া। এই সিস্টেমডা চালু থাহনে এই সমস্যাডাও দূর অইছে।’
শহরের পুরান থানা মোড়ে ফুটপাতে ডিম ভেজে আর সিদ্ধ করে বিক্রি করেন সুমন মিয়া। তার দোকানেও চালু আছে এই সেবা। দোকানের টেবিলের এক কোণে নিজের নম্বরটি ঝুলিয়েও রেখেছেন তিনি।
মুদির দোকানেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে। ছবি: নিউজবাংলাসুমন মুরগির ডিম সিদ্ধ বা ভাজি ১৫ টাকা আর হাঁসের ডিম ২০ টাকা করে বিক্রি করেন। হাঁসের ডিম বিক্রির ক্ষেত্রে খুচরার জটিলতা না দেখা দিলেও সমস্যা হয় মুরগির ডিম বিক্রিতে। পাঁচ টাকার নোট থাকে না অনেকের কাছে। বিকাশ থাকলে সমস্যা হয় না তার।
তিনি বলেন, ‘কাস্টমারে যদি কয় ভাংতি নাই, তহন বিকাশ নাম্বারটা দেহায়া দিয়া ডিমডা ছিলতে ছিলতে রিংটোনডা বাজলেই বুইজ্যালাই টেহা আমার নাম্বারে আয়া পড়ছে।’
সুমনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সিদ্ধ ডিম কিনে বিকাশে টাকা পরিশাধ করেন ফারহান অভি। তিনি বলেন, ‘পকেটে ভাংতি টাকা ছিল, তারপরও তার দোকানে এই সেবা চালু আছে দেখে মন চাইল বিকাশে দিতে। তাই প্রথমবারের মতো বিকাশ পেমেন্টের মাধ্যমে ডিম কিনে খেলাম। এখন থেকে পকেটে ভাংতি টাকা না থাকলেও আর টেনশন করতে হবে না। চমৎকার একটা সিস্টেম।’
শহরের বড় বাজারে ফুটপাতে বসে চিতই আর ভাপা পিঠা তৈরি করেন ৫৫ বছর বয়সী জয়তুন্নেচ্ছা খাতুন। তার দোকানেও চুলার এক কোণে টানানো আছে বিকাশ পেমেন্ট নম্বর। বিকাশ পেমেন্টের এই লেনদেন সম্পর্কে জয়তুন্নেচ্ছার ধারণা না থাকলেও তার কোনো সমস্যা হয় না। তাকে সহযোগিতা করেন তার ১২ বছর বয়সী নাতি তারেক।
জয়তুন্নেছা বলেন, ‘নগদ টেহা অইলে আমি লই। আর মোবাইলে যেরা টেহা দেয়, এইডা লয় আমার নাতি তারেকে।’
তারেক নিউজবাংলাকে বলে, ‘অহন বেহের মোবাইলেই বিকাশ চালু করা আছে। অনেক রিকশার ড্রাইভারেরাও বিকাশে টেহা দেয়।’