বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সড়কে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি এখন বাইকের কারণে

  •    
  • ২১ জানুয়ারি, ২০২২ ১০:২৮

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৯৪৫ জন। ২০২১ সালে দুর্ঘটনা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৮টি, মৃত্যু বেড়ে হয় ২ হাজার ২১৪ জনে। এ বছর সড়কে মৃত্যুর ৪০ শতাংশই ছিলেন বাইকার।

মঙ্গলবার গভীর রাত। রাজধানীর হাতিরঝিলে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারানো সময়ের আলো পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাবীব রহমানের আঘাত ছিল মুখমণ্ডলে। মাথায় ছিল হেলমেট, তবে মুখ ছিল খোলা।

যে হেলমেটটি হাবীব ব্যবহার করেন, সেটি পরিচিত ‘হাফ ফেস’ নামে। এর মুখের সামনে কোনো আচ্ছাদন থাকে না, থাকে একটি প্লাস্টিকের পাতলা আবরণ, যা মূলত বাতাস থেকে চোখকে রক্ষা করে।

সুরতহাল প্রতিবেদনে দেখা যায়, হাবীবের মুখমণ্ডল ছিল থেঁতলানো, চোয়াল বিচ্ছিন্ন, নাক ও মুখ থেকে রক্ত ঝরেছে। এ ছাড়া শরীরের বাকি অংশ স্বাভাবিক।

অর্থাৎ ‘ফুল ফেস’ হেলমেট থাকলে হাবীবের দুর্ঘটনাটি প্রাণঘাতী নাও হতে পারত। তার মুখের আঘাতটি হয়তো হেলমেটের সামনের অংশ প্রতিহত করতে পারত।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের তথ্য বলছে, বাইক দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যু হয় দিনে গড়ে ছয়টি। এখন দেশে যত মানুষ সড়কে মারা যান, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় বাইক আরোহীদেরই।

দেশের মহাসড়কগুলোতে এখন মোটরসাইকেলের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। ফাইল ছবি

কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে এই মৃত্যু। ২০১৯ সালে সারা বছরে এক হাজারের কম মৃত্যু রেকর্ড হলেও সদ্য সমাপ্ত ২০২১ সালে তা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

ভয় জাগানিয়া পরিসংখ্যান

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৯৪৫ জন।

পরের বছর দুর্ঘটনা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৮১টি, এসব দুর্ঘটনায় নিহত হন ১ হাজার ৪৬৩ জন।

২০২১ সালে দুর্ঘটনা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৮টি, মৃত্যু বেড়ে হয় ২ হাজার ২১৪ জনের।

নিহতের মধ্যে ৭৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।

এই সংগঠনের তথ্য বলছে, অন্য কোনো বাহনের এত যাত্রী মারা যাননি।

দুর্ঘটনার পর রাস্তার পাশে পড়ে আছে বাইক। ফাইল ছবি

২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন।

এদের মধ্যে বাইকারদের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাণহানি হয়েছে পথচারীদের। এই সংখ্যাটি ১ হাজার ৫২৩।

পরিবহন চালক ও শ্রমিক মারা গেছেন ৭৯৮ জন, যা মোট মৃত্যুর ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

বাইক দুর্ঘটনার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৪ দশমিক ৫০ শতাংশ) ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে। অর্থাৎ যেখানে দুই চাকার বাহনে চেপে মানুষের দূর যাত্রার প্রবণতা বাড়ছে।

৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ মৃত্যু ঘটেছে আঞ্চলিক সড়কে, ১৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ ঘটেছে গ্রামীণ সড়কে এবং ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ ঘটেছে শহরের সড়কে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোটরসাইকেলের চালকদের বড় অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদেরকে আক্রান্ত করছে।’

তিনি বলেন, ‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ ঘটছে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা ও মুখোমুখি সংঘর্ষে। এসব দ্রুতগতির চালকদের অধিকাংশই অদক্ষ ও অসুস্থ। তাদের বেপরোয়া যানবাহন চালানোর কারণে যারা সাবধানে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন তারাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও বাড়ছে।’

কী বলছে ট্রাফিক পুলিশ

রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট দুর্জয় হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার পরেও অনেকে বাইক কিনছেন। দুই-তিন বছর বাইক চালিয়ে এর পরে লাইসেন্স করেন। এ ছাড়া তরুণ বাইকাররা সিগন্যাল মানেন না। প্রযুক্তির ঘাটতি থাকায় বাইক নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ওভার স্পিডে বাইক টেনে চলে যায়, তাই তাদের ধরা সম্ভব হয় না।’

দুর্ঘটনায় পড়ে ট্রাকের নিচে বাইক। ফাইল ছবি

এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ২০টি ছোট গাড়ি বিক্রি না করে, একটা বড় গাড়ি বিক্রি করতে হবে, যাতে বেশি মানুষ চলাচল করতে পারে। ট্রাফিক আইন জেনে সেটা মানতে হবে। সর্বোপরি মানুষ সচেতন না হলে মৃত্যু কমানো সম্ভব না।’

মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়ছে

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ করে বাইক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ ২০২০ ও ২০২১ সালের বিভিন্ন মেয়াদে গণপরিবহন বন্ধ ছিল। তখন শুধু স্বল্প দূরত্ব না, দূরপাল্লার যাত্রায়ও মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এটা কখনোই কাম্য না।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে মোটরসাইকেল চালানো আর মহাসড়কে চালানোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে দূরের যাত্রায় এই মোটরসাইকেল ব্যবহারের ফলে দুর্ঘটনা বেড়েছে।’

জাপানে মোটরসাইকেল বেড়ে যাওয়ার কারণে দুর্ঘটনাও বেড়ে যাচ্ছিল বলে জানান এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ। বলেন, ‘জাপান গত ১০ বছরে সড়ক থেকে প্রায় ২৫ লাখ মোটরসাইকেল সরিয়ে ফেলেছে বিভিন্ন পলিসির মাধ্যমে। সংখ্যা কমানোর পর তাদের দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছে। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে।’

তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ন্ত্রণের যে পলিসি থাকার কথা, সেখানেও আমরা মনোযোগী হচ্ছি না, রাজস্ব আয়ের কথা বলে অনায়াসে অনিয়ন্ত্রিতভাবে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে যাচ্ছি। এর ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।’

মোটরসাইকেল নিবন্ধনের আবেদনের সঙ্গে ক্রেতার ড্রাইভিং লাইসেন্স যুক্ত করার পরামর্শও দেন তিনি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, যত বাইক সড়কে চলে, তার বেশির ভাগেরই নিবন্ধন নেই।

ওভারস্পিড আর যথাযথ হেলমেট না পরা

হাইওয়ে পুলিশের সিলেট বিভাগের পুলিশ সুপার মো. শহীদ উল্লাহ্‌ নিউজবাংলাকে বলেন, যথাযথ হেলমেট না পরা বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটি কারণ।

তিনি বলেন, ‘হেলমেটের ব্যবহার করে না, আবার অনেকে হেলমেট ব্যবহার করলেও ফুল ফেস হেলমেট ব্যবহার করে না। কিন্তু মোটরসাইকেলের জন্য নির্ধারিত ফুলফেস হেলমেট ব্যবহার করতে হবে।’

সড়কের পাশে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে অ্যাপে চলা বাইকগুলো। ফাইল ছবি

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এমনও তথ্য আছে, এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে বাবার কাছ থেকে মোটরসাইকেলের চাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে গেছেন। অনেকে তিনজন যাত্রী বহন করেন।

‘লং ড্রাইভে ক্লান্ত অবস্থায় বাইক চালানো দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ। উচ্চ সিসির গাড়ির সংখ্যা দেশে বেড়ে গিয়েছে। এর ফলে অনেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।’

বাইকাররা মহাসড়কে ওভারটেক করার বিধান মানেন না বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। বলেন, ‘ওভারটেক করতে হলে ডান দিক দিয়ে ওভারটেক করতে হবে। বাইকের চালকেরা ওভারটেক করার ক্ষেত্রে ডান-বাম মানেন না। মোটরসাইকেল ছোট গাড়ি হওয়ার পরেও বড় গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওভারটেকিং ও রেসিং করে।’

হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর বিভাগের পুলিশ সুপার আলী আহম্মদ খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘনবসতি বা জনবহুল এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকাতে কিন্তু হাইওয়ে থাকতে পারে না। বিশ্বে কোথাও দেখবেন না এত ঘনবসতি এলাকায় হাইওয়ে। সিটি করপোরেশন, মেট্রোপলিটনের মধ্য দিয়ে হাইওয়ে হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে আছে।’

‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তারুণ্যের একটা বিষয় আছে। এই তারুণ্যের কারণে উচ্চ গতিতে তারা মোটরসাইকেল চালান। এদের বেশির ভাগই ট্রাফিক নিয়ম জানেন না এবং ট্রাফিক ট্রেনিংটা ওভাবে হয় না। একটা লার্নার কার্ড জোগাড় করেই তারা মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।

‘পথচারীরাও ট্রাফিক নিয়ম মানেন না। মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হন অনেকে, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না। তাছাড়া ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডার পাসও ওভাবে নাই। যে কারণে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।’

এ বিভাগের আরো খবর