দেশে করোনা সংক্রমণ দুই সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার ৮ শতাংশ বেড়ে ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশের হাসপাতালগুলোয় নতুন করে প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
তবে হাসপাতাল, চিকিৎসক-নার্স, প্রয়োজনীয় সেবা সরঞ্জামসহ প্রস্তুতি এখনও চলছে ঢিমেতালে। রাজধানীসহ জেলা ও উপেজলার হাসপাতালগুলোয় খোঁজ নিয়ে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
দেশে তিন মাস করোনা পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক থাকায় অধিকাংশ হাসপাতালের করোনা ইউনিট বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক হাসপাতালের আইসিইউ সাধারণ রোগীদের সেবায় ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনা চিকিৎসার অনেক যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত পড়ে থাকায় তা আবার ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। অনেক হাসপাতাল নতুন করে যন্ত্রপাতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেছে।
অনেক হাসপাতালে রোগীদের জন্য শয্যা, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যেমন- অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, হাই ফ্লো ন্যাজ্যাল ক্যানোলা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর নষ্ট হয়ে আছে। অনেক জায়গায় চিকিৎসক ও নার্সের স্বল্পতা রয়েছে। ফলে সরকারি নির্দেশনার পরও প্রস্তুতিতে ধীরগতি দেখা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘দেশে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ ঘটছে। নতুন শনাক্ত হওয়া রোগীদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশই নতুন ধরন ওমিক্রণে আক্রান্ত। যার প্রভাবে সংক্রমণ বাড়ছে। আগামী পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে অনেক রোগী হয়ে যাবে হাসপাতালে। তখন আবার একটা কষ্টকর অবস্থা তৈরি হবে। চিকিৎসক-নার্সদের ওপর প্রেশার পড়বে। সিট পেতে সমস্যা হবে। মৃত্যুর হারও বেড়ে যাবে। সে জন্য নতুন করে ২০ হাজার শয্যার প্রস্তুতির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে সরকার যদি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সঠিকভাবে সামাল দিতে না পারে, তাহলে ব্যাপকভাবে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হবে। তখন মোকাবিলা করা কঠিন হবে। পরবর্তী সময়ে এটার একটা চাপ হাসপাতালগুলোয় পড়বে। সরকারের উচিত টিকাদানের পাশাপাশি এখন থেকেই বিভাগীয় এবং জেলার পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সব দিক থেকে সক্ষম করে গড়ে তোলা, যাতে কমিউনিটি টান্সমিশন শুরু হলেও চাপ সামলানো যায়। কারণ সংক্রমণ শনাক্তের প্রাথমিকভাবেই চিকিৎসা দেওয়া গেলে মৃত্যুহার কমানো যায়।’
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় করোনা রোগীদের জন্য পুরুষ ও নারীদের পৃথক দুটি ওয়ার্ড থাকলেও শনিবার দুটোই বন্ধ দেখা যায়। পাশেই কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) ইউনিট থাকলেও সেটি তালাবন্ধ। এ ব্যাপারে হাসপাতালসংশ্লিষ্টরা বলেন, করোনা উপসর্গ নিয়ে অনেকে বহির্বিভাগে এলেও ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার মতো জটিল পর্যায়ের না। ফলে ওয়ার্ড দুটি আপাতত ফাঁকা। রোগী বাড়লে সেবা কার্যক্রমও বাড়বে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, কয়েক সপ্তাহ ধরেই করোনা শনাক্ত হয়ে এবং উপসর্গ নিয়ে রোগী ভর্তি বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে উপসর্গ নিয়ে এখানে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এর মধ্যে টিকা নিয়েছেন এমন রোগীও রয়েছে।
হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ডা. মো. আশরাফুল আলম বলেন, রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় আবারও করোনা ইউনিটে শয্যা বাড়ানো হচ্ছে। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নতুন ভবনের ৭ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত কয়েকটি ওয়ার্ড ফাঁকা করা হয়েছে।
উত্তরার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাধায়ক ডা. সিহাব উদ্দীন বলেন, ‘এর আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা শুরু করেছিলাম। এখন আবার রোগী আসতে শুরু করছে। আজকেও ৪৮ জন ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৫ জন পজিটিভ, বাকিরা উপসর্গযুক্ত। এ ছাড়া ২৬টি আইসিইউ বেডের মধ্যে পাঁচটিতে করোনা রোগী রয়েছে। প্রতিদিনই ইনডোর ও আউডোরে রোগী বাড়ছে। ফলে দু-এক দিনের মধ্যে সাধারণ রোগীদের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়ামাতুজ্জামান বলেন, ‘গত বছরের শেষ দিকে রোগী কমে আসায় সরকারি নির্দেশনা অনুসারে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেছিলাম। এখন নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে সংক্রমণ পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী হলেও ভর্তি কম হচ্ছে। প্রস্তুতি হিসাবে পাঁচটি আইসিইউ, পাঁচটি এইচডিইউ এবং ৪০টি সাধারণ বেড সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজন হলে এটিকে আবারও ৩৫০ শয্যায় রূপান্তর করা হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘এখন সংক্রমণ ও মৃত্যু ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। যদিও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে তা তেমনভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ইতোমধ্যে নতুন ধরন ওমিক্রন ছড়াচ্ছে। এখন হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা ক্রমেই বাড়বে। এখনই হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার জন্য গাইডলাইন প্রয়োজন। সে অনুযায়ী নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ জরুরি।। এ ব্যবস্থা এখনই তৈরি করতে হবে, যাতে রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। উপজেলা থেকে রাজধানী পর্যন্ত এই ব্যবস্থা থাকবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকের তুলনায় এখন হাসপাতালের চিকিৎসা সক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। আইসিইউ শয্যা ও অক্সিজেন সিলিন্ডার তিন-চার গুণ বেড়েছে। আজও মুগদা মেডিক্যালসহ কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে নির্দেশনা দিয়েছি। জেলা-উপজেলা হাসপাতালেও জোর প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। প্রত্যেক বিভাগের সঙ্গে আলাদাভাবে ম্যানেজমেন্ট প্রটোকলের ব্যাপারে কথা বলছি। করোনা চিকিৎসায় বিকেন্দ্রীকরণে জোর দিচ্ছি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শনিবার পর্যন্ত সারা দেশে কোডিভ-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য ১৩ হাজার ৪৩৭টি সাধারণ শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ১ হাজার ১৯৭ জন। আর আইসিইউ শয্যা প্রস্তুত আছে ১ হাজার ২৩২টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ১৭০ জন। কোভিড এইচডিইউ শয্যা আছে ৭১৩টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ৪৮ জন। হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা আছে ২ হাজার ১৮টি। অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে ২ হাজার ৩৪৫টি।