পুরান ঢাকার অলি-গলিতে চলছে সাকরাইন উৎসবের প্রস্তুতি। বাহারি ঘুড়িতে ছেয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় পুরান ঢাকার আকাশ। উৎসবের আগের দিন চলছে ঘুড়ি, নাটাই, ফানুশ, আতবাজির সরঞ্জাম কেনার ধুম।
বৃহস্পতিবার সকালে গিয়ে দেখা যায় সাকরাইন আয়োজনে শেষ প্রস্তুতি চলছে পুরান ঢাকায়। সূত্রাপুর, নবাবপুর, শ্যামবাজার, ধূপখোলা, শাঁখারি বাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, ফরাশগঞ্জ, সদরঘাট, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, লালবাগ, চকবাজার, মুরগীটোলা, ধোলাইখালসহ বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে সাকরাইনের আমেজ। বিভিন্ন স্থান ও ছাঁদগুলোতে দেখা যায় ঘুড়ি ওড়ানোর রিহার্সালও।
ধূপখোলার ঘুড়ির দোকানগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের ঘুড়ি। এর মধ্যে রয়েছে চোখদার, রকদার, গরুদার, ভোমাদার, কাউঠাদার, মাছলেঞ্জা, ফিতালেঞ্জা, একরঙা, চানতারা, সাপঘুড়ি, প্রজাপতি, পেঁচা, বাক্স ঘুড়ি।
আঁতশবাজির মধ্যে আছে পাঁচ শট, বারো শট, একুশ শট, বত্রিশ শট, আশি শট, একশ বিশ শট, দেড়শ শট, কদম ফুল, তারা শট, ঝর্ণা, ব্যাটারি বোম, চকলেট বোম, শলতা বোম, রকেট বোম, পাতা বোম, ২৮ বোম, ফ্লেম টর্চ।
ফানুশেরও মধ্যেও রয়েছে হরেক রকম পদ। যেমন গোল ফানুস, হার্ট ফানুস, চারকোণা ফানুস।
তবে বিধিনিষেধ থাকায় আতশ বাজি ও ফানুশ বিক্রিতে দোকানিরা সাবধানতা অবলম্বন করছেন। পুলিশের ভয়ে অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়ে এসব পণ্য বিক্রি করছেন তারা।
রাধামাধব ভাণ্ডার শ্রী কাক্কেশ্বর জানান, তার দোকানে বিভিন্ন রঙের, দামের ও ধরনের ঘুড়ি রয়েছে। সর্ব নিম্ন ৬ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২০ টাকার ঘুড়িও আছে। দাম ফিক্সড। তবে ১০০০ বা এর বেশি পিস নিলে প্রতিটি ঘুড়িতে ১ টাকা করে কম রাখা হচ্ছে। আর সুতার দাম সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০০ টাকার পর্যন্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার এখন আবার লকডাউনের চিন্তাভাবনা করছে। আর এখন যদি লকডাউন দিয়ে দেয়, তাহলে বেচা কেনা কমে যাবে। উৎসবের আমেজও থাকবে না। এ ছাড়া সাকরাইনের দিনও আমাদের বেচা কেনা হয়।’
প্রতি বছর সাকরাইনে লক্ষাধিক ঘুড়ি বিক্রি করেন শাঁখারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। লাখ লাখ টাকার ঘুড়ি, নাটাই, সুতা বিক্রি হয় এই বাজারে। চশমাদার, কাউটাদার, পঙ্খিরাজ, প্রজাপতি, চক্ষুদার, ঈগল, সাদা ঘুড়ি, চারবোয়া, দুই বোয়া, টেক্কা, লাভ ঘুড়ি, ৩ টেক্কা, মালাদার, দাবা ঘুড়ি, বাদুর, চিল, অ্যাংগ্রি বার্ডসসহ নানা আকৃতির ঘুড়ি বিক্রি হয়।
সাধারণ ঘুড়ির দাম ৮ থেকে ২৫ টাকা। বিদেশি ও নকশা ঘুড়ির দাম ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। নানা রকমের বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, লোহা নাটাই, কাঠের নাটাই, চাবাডি নাটাই বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। ড্রাগন সুতা, ভুত সুতা, বিলাই সুতো, ঘুড়ি উড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের এই সুতা বিক্রি হয়ে থাকে ১৫০ থেকে ৫০০ টাকায়।
ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য আছে বিভিন্ন ধরনের সুতা। এর মধ্যে ক্যাঙ্গারু, বিচ্ছু, ড্রাগন সুতা ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য খুবই ভালো। সুতা গজ হিসেবে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়। মান অনুযায়ী ৬০০ গজ সুতা ৭০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
ঘুড়ি উড়ানোর জন্য বিভিন্ন আকারের নাটাই রয়েছে। নাটাই সাধারণত দুই ইঞ্চি থেকে সর্বোচ্চ ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। বাঁশ দিয়ে তৈরি করা একটি নাটাইয়ের সর্বনিম্ন দাম ৭০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া রুপার ও লোহার তৈরি নাটাই পাওয়া যায়। সেগুলোর দাম বেশি।
শাঁখারী বাজারের ব্যবসায়ী শঙ্খ শ্রী ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী তারক রায় বলেন, ‘ভালোই বেচা কেনা চলছে আমাদের। আমাদের পাইকারি কাস্টমার বেশি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা এসে ঘুড়ি নিয়ে যান। দোকানে ৮ থেকে ১০ রকমের ঘুড়ি রয়েছে। নাটাই, সুতা ও ভালোই বিক্রি হচ্ছে।’
করোনা না থাকলে বিক্রি আরও বেশি হতো বলে দাবি এই ব্যবসায়ীর। বলেন, ‘‘করোনাভাইরাসের কারণে গত বারের ন্যায় এবার ও ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। অর্ডার কমে গেছে, তারপরও মোটামুটি চলছে। আমরা বছরজুড়েই ঘুড়ি-নাটাইয়ের ব্যবসা করি। সাকরাইন উপলক্ষে একটা অন্যরকম আমেজ সৃষ্টি হয় ব্যবসায়। আমাদের মূল ক্রেতা তরুণ-তরুণী। এবার অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পরিবার থেকে শিশুদের হাতে সেভাবে টাকা দেয়া হচ্ছে না।’
শাখারি বাজারে গেন্ডারিয়া থেকে ঘুড়ি কিনতে এসেছে মিরাজ ও তার বন্ধু আরমান। দুজনই ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তারা জানান, তাদের কাছে এই উৎসব অনেক ভালো লাগে। প্রতিবছর জানুয়ারি মাস আসলে আনন্দ লাগে। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ান, কাটাকাটি করেন।
নারিন্দার থেকে হৃদয় বাবু তার সন্তানকে নিয়ে এসেছেন ঘুড়ি কিনতে। তিনি বলেন, ‘এক সময় আমরা ঘুড়ি উড়িয়েছি। এখন আমাদের বাচ্চাদের সময়, তাই তাদের জন্য প্রতিবছর ঘুড়ি কিনে দিতে হয়।’
মুজাহিদ বিল্লাহ নামের স্থায়ী এক বাসিন্দা জানান, ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি তারা পৌষ সংক্রান্তির পিঠা উৎসব করে থাকেন। এই উৎসবে তারা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াতও দিয়ে থাকেন।
শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হবে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উৎসব সাকরাইন। মহাভারতে যেটাকে মকরক্রান্তি বলা হয়। এই দিনে দিনভর ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রংবেরং ফানুশে ছেয়ে যায় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী এলাকা।
পুরান ঢাকা ছাড়াও ঢাকার অন্যান্য এলাকায় এই উৎসব পালন করা হয়। আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সাকরাইন পালন করলেও এখন বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে সব ধর্মের মানুষ এটি পালন করে।
জানা যায়, পুরান ঢাকায় পুরনো যেসব উৎসব যুগের পর যুগ পালিত হয়ে আসছে, তার মধ্যে এই সাকরাইন অন্যতম। এই সংক্রান্তিতে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। দেশ থেকে দেশান্তর হয়ে আস্তে আস্তে এটি পুরান ঢাকার একটি সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।
প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৭৪০ সালের পৌষ মাসের শেষ এবং মাঘ মাস শুরুর সন্ধিক্ষণে মোঘল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উৎসবের প্রচলন চালু হয়। কালের পরিক্রমায় দিনটি পুরান ঢাকাইয়াদের একটি অন্যতম উৎসব এবং আমেজে পরিণত হয়েছে।
সূত্রাপুর অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা আরফিন সানজু বলেন, ‘পুরান ঢাকার সাকরাইন একটি ঐতিহ্য, যা ১৭০০ সালের থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে। ১৪ জানুয়ারি প্রতি বছর উৎসবটি পালন করা হয়ে থাকে। আমরা সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছি, এটা আমাদের কাছে এটি অন্যতম আনন্দের দিন। আমরা ঢাকাইয়ারা সব সময় এই ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
তবে পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা রইছউদ্দীন বলেন, ‘উড়ন্ত আগুন তথা ফানুস, ডিজে-লাউড স্পিকার, আতশবাজি ও শব্দ দূষণমুক্ত সাকরাইন (ঘুড়ি উৎসব) চাই।’
৩৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুর রহমান মিয়াজি বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডে মহল্লাভিত্তিক সাকরাইনের উৎসব হয়, সেটা অনুষ্ঠিত হবে। তবে সিটি করপোরেশন থেকে আমরা এখনও কোনো প্রোগ্রাম পাইনি।’