তিন মাস নিয়ন্ত্রণে থাকার পর দেশে গত তিন সপ্তাহ আবার ঊর্ধ্বমুখী করোনা সংক্রমণ । প্রতিদিন শনাক্ত, মৃত্যুসংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকা ও প্রতিবেশী ভারতের মতো দেশে সংক্রমণের একটি নতুন ঢেউ প্রবেশ করেছে।
তারা বলছেন, আগামী দুই মাস খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ যেকোনো সময় সংক্রমণ দ্বিগুণ হতে পারে। এ ছাড়া নতুন শনাক্ত হওয়া ওমিক্রন পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক করে তুলতে পারে। এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে সংক্রমণের লাগাম টানা চ্যালেঞ্জ হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, পরীক্ষা বিবেচনায় টানা তিন মাস করোনা শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে ছিল। এই হার বৃহস্পতিবার ৫ শতাংশের কাছাকাছি এসেছে। দুই-এক দিনের মধ্যে এই হার ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ১৪০ জনের দেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যা গত ২৯ সেপ্টেম্বরের পর সর্বোচ্চ।
নতুন বছরের এক সপ্তাহ সংক্রমণ বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। মৃত্যু বেড়ে ৪২ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়ায়। গত শনি থেকে রোববার ২৪ ঘণ্টায় ৫৫৭ জনের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়ে। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১২ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরপর ৩ জানুয়ারি শনাক্ত রোগী সাড়ে ৬০০ ছাড়িয়ে যায়। পাশাপাশি তিন মাস পর নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায় ওই ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৭৪ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ে এবং ৪ জনের মৃত্যু হয়।
সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় এর পরদিন মঙ্গলবার দৈনিক শনাক্ত সাড়ে ৭০০ ছাড়িয়ে যায়। শনাক্ত হার ৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছায়। এ সময় ৭৭৫ জন সংক্রমিত ও ৬ জনের মৃত্যু হয়। এভাবে বুধবার আরও বেড়ে সংক্রমণ প্রায় ৯০০ (৮৯২)-এর ঘরে পৌঁছে যায়। তিনজনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার আক্রান্তের সংখ্যা এক লাফে হাজারের ঘর ছাড়িয়েছে।
বুধবার নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ২০ শতাংশ। বৃহস্পতিবার তা বেড়ে ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়েছে।
গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ হওয়ার পর তা কমতে শুরু করে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। পরে ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার নামে ৫ শতাংশের নিচে। টানা দুই সপ্তাহ এই হার থাকার পর ৩ ফেব্রুয়ারি নিশ্চিত হয় করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সেবার টানা দুই দিন সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে ছিল। সেদিন শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে নেমে আসে।
তবে গত বছরের মার্চের শেষে সংক্রমণ আবার বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। এক দিনে ২০০-এর বেশি মৃত্যু হতে থাকে। তবে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ কমে যায়। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণ স্বস্তিদায়ক ছিল।
তৃতীয় ঢেউয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত তিন সপ্তাহ ধারাবাহিকভাবে সংক্রমণ বাড়ছে। সে হিসাবে আমার মনে হয় আরেকটি ঢেউ (থার্ড ওয়েভ) চলে আসছে। যেকোনো মুহূর্তে আক্রান্তের হার কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
‘সংক্রমণ পাঁচ শতাংশের বেশি হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী আমরা এটাকে ঝুঁকি হিসেবে ধরি। এর আগে বেশি ঝুঁকি তৈরি করছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে ওমিক্রন, যা মাত্র কয়েকজনের মধ্যে শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু এটি দ্রুত ছড়ায় এবং দুর্বল করে ফেলে। ফলে এই জায়গায় একটা ভয় তৈরি হয়েছে। এ জন্য আগামী দুই-তিন মাস খুব বেশি সতর্ক থাকতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সাবেক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যায়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বলেন, ‘বিশ্বের সব জায়গাতেই তৃতীয় ঢেউ আসছে। বাংলাদেশেও এটা হতেই পারে। তবে এখনও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি হয়নি। তৃতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রে ওমিক্রনের কথা বলা হচ্ছে। তাতে মৃত্যুহার খুবই কম। সুতরাং আরও কিছুদিন দেখতে হবে, সংক্রমণ কোথায় পৌঁছায়। তখন বিষয়টা স্পষ্ট হবে।
‘এদিকে ডেল্টা ও ওমিক্রন রোধে টিকার বুস্টার ডোজের কার্যক্রম চলছে, তবুও ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এর কারণ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমরা এখনও সবাইকে টিকার আওতায় আনতে পারিনি। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না। দ্রুত টিকাকরণ, স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং জনসমাগম এড়ানো ছাড়া ভাইরাসটি রোধের বিকল্প কোনো উপায় নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ যেভাবে উচ্ছ্বাস নিয়ে চেলাফেরা করছে, এটা কোনোভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। মনে রাখতে হবে, আমরা এখনও সংক্রমণমুক্ত নই, সেভাবেই আমাদের চলতে হবে। সরকারের দায়িত্ব টেকনিক্যাল কমিটি যেভাবে বলে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে সেটা মানার নির্দেশনা দেয়া। কিন্তু মানুষকে মনে রাখতে হবে, রোগটি তার, সুতরাং ব্যক্তিকেই আগে সচেতন হতে হবে।’
সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. এ এস এম আলমগীর দাবি করেন, ওমিক্রন নয়, দেশে এখনও ডেল্টা ধরন প্রাধান্য বিস্তার করছে। সঙ্গে মাস্ক না পরা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমাগম বাড়ায় সংক্রমণও বাড়ছে।
ডা. আলমগীর আরও বলেন, বাংলাদেশে এখনও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টেরই প্রাধান্য। ওমিক্রনের বিস্তার এখনও সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। ওমিক্রনের দুয়েকজন লোক পাওয়া যাচ্ছে। তবে যখন ওমিক্রন পাওয়া যাবে, তখন দেখা যাবে আক্রান্ত সবাই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় একই অবস্থা। তবে আমাদের এখানেও ওমিক্রন ছড়াবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে শনাক্ত ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। এ থেকে বলা যায়, সংক্রমণ বাড়তে পারে। তবে এখন যারা সংক্রমিত হচ্ছে, তারা সবাই ওমিক্রনে আক্রান্ত নয়। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপরে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যে ভ্যারিয়েন্ট আসুক না কেন, সেটি কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, তা সবার স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপরেই নির্ভর করে। এখানে জনগণের ও সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগ স্বাস্থ্যবিধি পালনের ওপরেই নির্ভর করে সংক্রমণ কতটা ছড়াবে বা কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।’