পুঁজিবাজারে প্রায় চার মাসের দর সংশোধনের আভাস আরও স্পষ্ট হলো টানা ছয় দিনের উত্থানে। দীর্ঘ হতাশার অবসান ঘটিয়ে শেয়ারগুলো এই চার মাসে হারিয়ে ফেলা দর একটু একটু করে ফিরে পাচ্ছে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দর সংশোধনের পর এমন টানা সূচক বৃদ্ধি আর দেখা যায়নি।
এর আগে গত ৩১ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা আট দিন সূচক বেড়েছিল। ১২ সেপ্টেম্বরের দর সংশোধন শুরুর দিন সূচক ৭৪ পয়েন্ট বেড়েও পরে কমে যায় ৫৬ পয়েন্ট। বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিল টানা উত্থানের পর দুয়েক দিন পতন এমন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু এর পর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, দর সংশোধন শুরু হয়েছে।
এই সংশোধনের আগে জুনের শেষ থেকে আড়াই মাস টানা বেড়েছিল পুঁজিবাজার। এমন উত্থানের পর সংশোধন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই দর সংশোধনের সময় বেশ কিছু ইস্যু সামনে আসে, যা বাজারে আস্থার সংকট তৈরি করে।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যকার মতভিন্নতার বিষয়টি সামনে চলে আসার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। এর মধ্যে বছর শেষে ব্যাংক-বিমা-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় চাপসহ আরও কিছু বিষয় সামনে চলে আসে। যে কারণে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে টানা দরপতন হতে থাকে।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে সূচক ও শেয়ারদর একটু একটু করে বাড়তে থাকলেও সেটি তেমন গুরুত্ব পায়নি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
বছরের শেষ চার কর্মদিবসের তিন দিন সূচক বৃদ্ধির পর নতুন বছরের প্রথম পাঁচ কর্মদিবসেও তা অব্যাহত থাকে।
এই পাঁচ দিনেই সূচক বাড়ল ২৩০.৭৯ পয়েন্ট আর নয় দিনে বাড়ল ৩৫৭.৫৭ পয়েন্ট।
এর আগে গত ৩১ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা আট দিন সূচব বেড়েছিল ৩৭৮.৪৮ পয়েন্ট।
উত্থানের টানা ষষ্ঠ দিনে মোট ২৫৬.৩০ পয়েন্ট সূচক বাড়ার দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
কেবল সূচক নয়, লেনদেনের খরাও কাটতে শুরু করেছে। গত ২১ নভেম্বরের পর লেনদেন প্রথমবারের মতো দেড় হাজার কোটি টাকার ঘর ছাড়াল।
সেদিন লেনদেন ছিল এক হাজার ৭৮৬ কোটি ২৭ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ৩৩ কর্মদিবস পর বৃহস্পতিবার লেনদেন হলো এক হাজার ৬৮৩ কোটি ৪৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।
আগের দিন লেনদেন ছিল ১ হাজার ৪১৪ কোটি ১৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। এক দিনেই লেনদেন বেড়েছে ২৬৯ কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
দিন শেষে সূচক বেড়েছে ৫৭.৫১ পয়েন্ট। সূচক দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৯৮৭.৪৫ পয়েন্ট।
তবে সূচক বাড়লেও বেশিরভাগ শেয়ারের দর কমেছে। দিন শেষে বেড়েছে ১৬৪টি কোম্পানির দর, কমেছে ১৭৯টির দর। অপরিবর্তিত ছিল ৩৫টির।
সূচকের এই অবস্থান গত ৭ ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের দিন উত্থানে সেদিন সূচক ছিল ৭ হাজার ৪৮.৯৯ পয়েন্ট।এদিন ৯টি কোম্পানির দর বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততটাই। এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে দুটি ছাড়া বাকিগুলোর দর টানা কমছিল।
বেশিরভাগ শেয়ারের দর কমলেও সূচক বাড়ার প্রধান কারণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দর বৃদ্ধি। ব্যাংক খাতও সূচক বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
এ ছাড়া প্রকৌশল খাতের ৫০ শতাংশ, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৪৫ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে।
বেশিরভাগ কোম্পানি দর হারালেও লেনদেনে সেরা ছিল বিমা খাত। বেশ কয়েক মাস পর এক দিনে আড়াইশ কোটি টাকা ছাড়াল এই খাতের লেনদেন। এর মধ্যে আবার জীবন বিমা খাতে লেনদেন ছিল সাধারণ বিমার প্রায় দ্বিগুণ।
এরপর যথাক্রমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ব্যাংক, ওষুধ ও রসায়ন, বস্ত্র ও প্রকৌশল খাত ছিল পরের অবস্থানে।
সব মিলিয়ে ৭টি খাতে লেনদেন হয়েছে একশ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বিমা ও বিবিধ খাতে লেনদেন ছিল দুই শ কোটি টাকার বেশি।
সূচক সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে যেসব কোম্পানি
সূচক বাড়িয়েছে যেসব কোম্পানি
সূচক বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির। শেয়ারদর ২.৯৭ শতাংশ বাড়ার পর কোম্পানিটি সূচকে যোগ করেছে ৫.২৫ পয়েন্ট।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা লাফার্জ হোলসিম সিমেন্টের পর ৪.৭৬ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ৫.১৯পয়েন্ট।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের তিতাস গ্যাসের শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৯৫ শতাংশ। এতে সূচক বেড়েছে ৪.৪২ পয়েন্ট।
বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির দর বেড়েছে ৭.৯ শতাংশ। এতে সূচক বেড়েছে ৩.৩১ পয়েন্ট।
টেলিকম খাতের গ্রামীণফোন সূচক উত্থানে ৩.১ পয়েন্ট, বিএটিবিসি ২.৮ পয়েন্ট। ডেল্টা লাইফ ২.৬৩ পয়েন্ট, পাওয়ারগ্রিড ২.৪১ পয়েন্ট, এনআরবিসি ২.৩২ পয়েন্ট আর ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ ২.৩১ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানির কারণেই সূচকে যোগ হয়েছে ৩৩.৭৪ পয়েন্ট।
অন্যদিকে রেনাটার দর ০.৬৬ পয়েন্ট কমায় সূচক কমেছে ১.০১ পয়েন্ট। সোনালী পেপার, জেনেক্স ইনফোসিস, ইউনিলিভার রেকিট বেনজিনজার, ফরচুর সুজ, ন্যাশনাল লাইফ, লাভেলো আইসক্রিম, ফারইস্ট লাইফ ও সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল সূক কিছুটা কমেছে। তবে এই ১০টি কোম্পানি মিলিয়ে সূচক খুব বেশি কমাতে পেরেছে-এমন নয়।
এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে সবচেয়ে বেশি
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
বৃহস্পতিবার সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশ বেড়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপয়ার্ডের দর। এতে ১২ টাকা দরের শেয়ার দর পৌঁছেছে ১৩ টাকা ২০ পয়সায়।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের শেয়ার দর আবার দিনের দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়েছে। কোম্পানিটির দর ৯.৮৯ শতাংশ বেড়ে এক শ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
লভ্যাংশ ও প্রথম প্রান্তিক ঘোষণার পর ১০ কর্মদিবসে ৪৯ টাকা ৯০ পয়সা থেকে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে হয়ে গেছে ১০৪ টাকা ৬০ পয়সা।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা ডেসকোর শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৯৭ শতাংশ, চতুর্থ স্থানে থাকা তিতাস গ্যাসের দর ৯.৯৪ শতাংশ, পঞ্চম শতাংশে থাকা মীর আক্তার হোসেন লিমিটেডের দর বেড়েছে ৯.৯২ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া ৬টি খাত
আরও চারটি কোম্পানির শেয়ার দর এদিন নয় শতাংশের বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে আলহাজ্ব টেক্সটাইলের দর ৯.৮৭ শতাংশ, বসুন্ধরা পেপার মিলসের দর ৯.৮৭ শতাংশ, এনআরবিসি ব্যাংকের দর দর ৯.৮১ শতাংশ ও ডেল্টা লাইফের শেয়ার দর বেড়েছে ৯.০৩ শতাংশ।
দশম স্থানে থাকা বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির দর বেড়েছে ৭.৯০ শতাংশ। এই কোম্পানিটির দরও এর চেয়ে বেশি বাড়া সম্ভব ছিল না এক দিনে।
আরও দুটি কোম্পানির দর ৭ শতাংশের বেশি, ২টির দর ৬ শতাংশের বেশি, ৪টির দর ৫ শতাংশের বেশি, ৮টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ১১টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ২৩টির দর বেড়েছে ২ শতাংশের বেশি।
দর পতনের শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি শেয়ার দর হারিয়েছে লাভেলো আইসক্রিমের দর ৮.৭৮ শতাংশ। পাঁচ শতাংশের বেশি শেয়ার দর হারিয়েছে তিনটি কোম্পানির। এর মধ্যে ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর ৫.৪০ শতাংশ, এমারেল্ড অয়েলের দর ৫.৩৪ শতাংশ এবং অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের দর কমেছে ৫.০২ শতাংশ।
চার শতাংশের বেশি শেয়ার দর কমেছে ছয়টি কোম্পানির। এর মধ্যে সিভিও পেট্টোকেমিক্যালের দর ৪.৭৬ শতাংশ, ঢাকা ডাইংয়ের দর ৪.৭৪ শতাংশ, সুহিৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের ৪.৫০ শতাংশ, সোনালী পেপারের দর ৪.২৪ শতাংশ, পেপার প্রসেসিংয়ের দর ৪.১৪ শতাংশ এবং ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টের দর কমেছে ৪.১১ শতাংশ।
আরও ১৫টির দর ৩ শতাংশের বেশি, এবং ৩৫টির দর কমেছে ২ শতাংশের বেশি।
৩৩ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেনের দিনে বেশিরভাগ খাতেই শেয়ার কিনেছেন বিনিয়োগকারীরা
লেনদেনে সেরা যেসব কোম্পানি
টাকার অংকে এদিন সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। ১১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকায় কোম্পানিটির ৫৬ লাখ ৪৭ হাজার ৩০৮ টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে লেনদেন হয়েছে ১১২ কোটি ১২ লাক টাকা। হাতবদল হয়েছে ৭৪ লাখ ৫৫ হাজার ৫০৩টি শেয়ার।
এছাড়া বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে ৭৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, পাওয়ারগ্রিডের ৬৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা, লাফার্জ হোলসিমে ৪৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ফরচুন সুজে ৪০ কোটি ৭১ লাখ টাকা, ওয়ান ব্যাংকে ৩৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানিতে ৩৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং লাভেলো আইসক্রিমে লেনদেন হয়েছে ৩১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
দশম স্থানে থাকা অ্যাকটিভ ফাইনের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।