বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মেজর জিয়াকে শেষ দেখা গিয়েছিল চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে

  •    
  • ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:০৫

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জিয়াকে গ্রেপ্তারে বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একাধিক ইউনিট। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহে তার অবস্থান শনাক্ত করা হয়। প্রতিবারই তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এখন তিনি দেশে আছেন, নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তা নিয়ে দুই রকম তথ্য আছে।

সেনাবাহিনী থেকে ২০১২ সালে বহিষ্কার হওয়ার পর থেকে মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া পলাতক। এই সময়ে অন্তত চারবার তার অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তবে তিনি গ্রেপ্তার এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।

জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাকে সবশেষ দেখা গেছে ২০১৯ সালের জুনে ঈদুল ফিতরের আগে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে।

সেখানে টিকিট কাটতে গিয়েছিলেন জিয়া। টিকিট না পেয়ে হট্টগোল করেন। খবর পেয়ে পুলিশ আসার আগেই তিনি সটকে পড়েন। পরে পুলিশ এসে নিশ্চিত করে হট্টগোল করা ব্যক্তিটি জিয়া ছিলেন।

এরপর আর কোথাও তার অবস্থান শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কোনো ইউনিট।

২০১২ সালে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর সৈয়দ জিয়াউল হক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে পলাতক। জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর ‘আনসার আল ইসলাম’ নাম ধারণ করে। জিয়াও আনসার আল ইসলামের দায়িত্ব নেন সামরিক কমান্ডার হিসেবে।

২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধিক টার্গেট কিলিংয়ের সঙ্গে জিয়ার জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তার বিরুদ্ধে মোট ১১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ব্লগার রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, নিলাদ্রী নিলয় ও জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডসহ ছয়টিতে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জিয়াকে গ্রেপ্তারে বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একাধিক ইউনিট। তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহে তার অবস্থান শনাক্ত করে, কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবারই তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

প্রায় একযুগের পলাতক জিয়া এবং তার আরেক সহযোগী আকরাম হোসেনকে ধরিয়ে দিতে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তর। এ দুজন বাংলাদেশেই রয়েছে বলে আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে দাবি করা হয়েছে।

আমেরিকার এই পুরস্কার ঘোষণার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘মেজর জিয়া চতুর লোক। আমাদের কাছে তথ্য আছে, তিনি হয়তো অন্য দেশে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন।’

পুরস্কার ঘোষণার পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া কোথায় আছেন?

জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) জানিয়েছে, ২০১৯ সালের মার্চে ঢাকা ও জুনে চট্টগ্রামে শনাক্ত হওয়ার পর আর কোথাও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সিটিটিসি প্রধান ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা জিয়াকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের নিয়মিত নজরদারি রয়েছে।’

জিয়া দেশে আছেন না দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না সিটিটিসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে তার কোনো মুভমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না। আনসার আল ইসলামের সাধারণ সদস্যদের সঙ্গেও তিনি কোনো যোগাযোগ করছেন না। তাদের ধারণা, জিয়া শুধু বড় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

২০২০ সালের নভেম্বরে উত্তরা থেকে সাব্বির নামে আনসার আল ইসলামের দাওয়া বিভাগের একজনকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় জিয়ার সঙ্গে সাব্বিরের দেখা হয়েছিল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাদের কথা হয়।

সিটিটিসি জানায়, বাড্ডার রাতারকুল এলাকায় একসময় বসবাস করতেন জিয়া।

জিয়া কীভাবে এত দীর্ঘ সময় পলাতক থাকতে পারছেন, জানতে চাইলে সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, জিয়া অন্য জঙ্গিদের থেকে আলাদা। তিনি সেনাবাহিনীর একজন চৌকস অফিসার ছিলেন। উচ্চতর প্রশিক্ষণ এবং সাইবার যোগাযোগে রয়েছে তার দক্ষতা।

একজন কর্মকর্তা বলেন, জিয়া তার সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে কাট-আউট পদ্ধতিতে যোগাযোগ করেন। কোথাও যাওয়ার আগে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রেকি করান। নিজস্ব লোক দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন।

জিয়া দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে মনে করছেন পুলিশের এলিট ফোর্স- র‌্যাব।

বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শনাক্ত করা ও আসামিদের গ্রেপ্তারে র‌্যাবই প্রথম কাজ করে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের আসামিদের বিচার নিশ্চিতে সরকার দৃঢ়ভাবে কাজ করেছে। এ হত্যার পর মেজর জিয়াকে বিভিন্নভাবে খুঁজে বের করার জন্য র‌্যাব কাজ করেছে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের একাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সঙ্গে মেজর জিয়ার সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। এই মাধ্যমেও তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে র‌্যাব।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘এর আগে বিভিন্ন সময় তথ্য ছিল মেজর জিয়া দেশে আছেন, পরবর্তী সময়ে আমরা গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করি। আমরা সন্দেহ করছি, তিনি এখন দেশের বাইরে। মেজর জিয়াকে গ্রেপ্তারে র‌্যাবের অভিযান চলছে, গোয়েন্দা নজরদারিও চলমান। এ বিষয়ে র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে।’

অভ্যুত্থান চেষ্টাকারী থেকে জঙ্গি নেতা

২০১২ সালে অভ্যুত্থান চেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে সেনাবাহিনী। ওই বছরের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তৃতীয় কর্মকর্তা সৈয়দ জিয়াউল হক পালিয়ে গেছেন। তাকে ধরিয়ে দিতে ছবিসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেয়া হয় সে সময়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াসে পরিকল্পনাকারী মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক গত ২২ ডিসেম্বর (২০১১) অন্য এক কর্মরত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তাকেও রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড তথা সেনাবাহিনীকে অপব্যবহার করার কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে প্ররোচনা দেন।

‘ওই কর্মকর্তা বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানালে সদ্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ সম্পন্নকারী মেজর জিয়ার ছুটি ও বদলি আদেশ বাতিল করে তাকে দ্রুত ঢাকার লগ এরিয়া সদর দপ্তরে যোগ দিতে বলা হয়। বিষয়টি টেলিফোনে গত ২৩ ডিসেম্বর তাকে জানানো হলেও তিনি পলাতক থাকেন।’

জিয়া পালিয়ে যাওয়ার পরের বছর জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১৩ সাল থেকে একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার রাজীব হায়দার, ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান, ব্লগার অনন্ত দাস, ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ব্লগার নাজিম উদ্দিন, সমকামীদের অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়।

পুলিশ বলছে, এই ৯ হত্যাকাণ্ডের আটটিতেই জড়িত আনসার আল ইসলামের সদস্যরা। এর মধ্যে ছয়টি হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন এই চাকরিচ্যুত মেজর।

জিয়াউল হকের বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। তাদের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। জিয়া পড়াশোনা করেছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। কলেজ জীবন শেষে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

জিয়ার বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকতেন সৌদি আরবে। সেই সুবাদে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আগেই কয়েকবার ওমরাহ করেছিলেন জিয়া। শিক্ষা জীবনে তিনি বরাবর মেধাবী ছিলেন। কলেজ জীবনে তিনি ছিলেন সেরা অ্যাথলেট।

১৯৯৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে জিয়া সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ক্যাডেট জীবনে তিনি ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন মেনে চলতেন বলে জানিয়েছেন তার স্কুলের বন্ধুরা।

২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় পুলিশ। জিয়া জঙ্গিদের যুদ্ধ ও বোমা তৈরিসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।

পুলিশ জানায়, ২০১৩ সালে এবিটি প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানী গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই নিষিদ্ধ সংগঠনের অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে জিয়ার নাম সামনে আসে।

২০১৬ সালে ২ আগস্ট মেজর জিয়া ও তামিম চৌধুরীকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা দেয় পুলিশ।

সিটিটিসির সাবেক প্রধান ও বর্তমানে বিশেষ শাখা (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জিয়া সম্পর্কে বলেন, ‘মেজর জিয়া আত্মগোপনে আছেন। তাকে আটক করতে আমরা কিছু কৌশল অবলম্বন করছি। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাংগঠনিক অবস্থা এখন একেবারেই দুর্বল। তিনি যদি কখনও তার পুরাতন নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন, অবশ্যই ধরা পড়বেন।’

এ বিভাগের আরো খবর