পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতভিন্নতা দূর করতে বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠকটি চলতি বছরের বাকি কয়েক দিনে আর হচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগকারীদের নতুন বছরের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
গত ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলোচিত সেই বৈঠক শেষে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না জানিয়ে পরের বৈঠকের অপেক্ষায় রাখা হয়। জানানো হয়, ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আরও একটি বৈঠকের পর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসবে।
সেই বৈঠকের পর থেকে ক্রমাগতভাবে দরপতন ঘটছে। ১২ কর্মদিবসের মধ্যে ১০ দিনেই সূচক পড়ে ৪১৯ পয়েন্ট। এ অবস্থায় দ্বিতীয় সেই বৈঠকের অপেক্ষায় থাকা বিনিয়োগকারীরা জানতে পারছেন না কবে বসবেন কর্তাব্যক্তিরা, কবে একটি ঘোষণা শোনা যাবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ডিসেম্বর তথা চলতি বছর শেষ হতে বাকি মাত্র চার দিন। কিন্তু এখন পর্যন্ত অংশীজনদের সঙ্গে পুনরায় বসার সময়সূচি ঠিক করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। আর আগের বৈঠকের সারসংক্ষেপই এখনও তৈরি হয়নি। ফলে পরের বৈঠকের জন্য নথিপত্র প্রস্তুত করা যায়নি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব (পুঁজিবাজার) নাহিদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘ বিরতির পর গত ৭ ডিসেম্বর এ সম্পর্কিত প্রথম বৈঠক হয়েছে। এখনও ওই বৈঠকের আলোচনার সার্বিক বিষয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কার্যপত্র তৈরি শেষ হয়নি। তা শেষ হলেই মন্ত্রণালয়ের কর্মসূচি দেখে পুনরায় বৈঠক বসার সময়সূচি ঠিক করা হবে।’
জানতে চাইলে সেই বৈঠকের প্রধান অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং শেয়ারবাজার কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকি কমিটির আহ্বায়ক মফিজ উদ্দীন আহমেদ নিউজবাংলাকে জানান, ‘এখনও পরবর্তী বৈঠকের সময়সূচি ঠিক করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু মাস শেষ হতে আর খুব বেশি দিন নেই, তাই চলতি মাসে বা চলতি বছরে পুঁজিবাজার উন্নয়নসংক্রান্ত বৈঠকে বসা আর হবে না। নতুন বছরের প্রথম মাসেই এ বিষয়ে আমরা বৈঠকে বসব।’
এমটিবি ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহী খায়রুল বাশার মোহাম্মদ আবু তাহের নিউজবাংলাকে বলেন, যেহেতু এ বৈঠকটিকে ঘিরে পুঁজিবাজারে টালমাটাল অবস্থা, তাই যত দ্রুত সম্ভব সেটি হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থায় এ ধরনের মিটিং আবার হওয়া উচিত ছিল। কারণ বলা হয়েছিল, পরবর্তী মিটিংয়ে সৃষ্ট জটিলতার সমাধানের বিষয়ে কথা হবে। যেহেতু এই সময়ে হচ্ছে না, সেহেতু অপেক্ষা করতে হবে।’
খায়রুল বাশার বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ে যে কমিটির কথা বলা হচ্ছে সেটি আগে থেকেই গঠন করা। তারা বিভিন্ন সময় পুঁজিবাজারের বিষয়ে সমন্বয় মিটিং করে থাকেন। পুঁজিবাজার ভালো থাকুক আর মন্দ থাকুক, এ ধরনের মিটিং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ তৈরি করে।’
তবে এ বৈঠকেই পুঁজিবাজারের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, সেটি ভাবেন না খায়রুল বাশার। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত, কোম্পানির শেয়ার বাছাই ইত্যাদির ওপরও পুঁজিবাজার ফান্ডামেন্টাল নির্ভর করে।’
কী নিয়ে বৈঠক
২০২০ সালের মাঝামাঝি শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে বিএসইসির নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পুঁজিবাজার এক দশকের মন্দাভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। জুন থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত টানা উত্থানের পর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাজার সংশোধনে প্রায় ৯০০ পয়েন্ট সূচক কমে।
দৈনিক লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকার ঘর থেকে নেমে আসে ৪০০ কোটি টাকার ঘরে।
৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরেক দফা উত্থানে সূচক বাড়ে প্রায় ২ হাজার পয়েন্ট। নিয়মিত লেনদেন হতে থাকে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা।
তবে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে দর সংশোধন শুরু হয়। এর মধ্যেও একটি নতুন প্রবণতা দেখা দেয়। সংশোধনে স্বল্প মূলধনি ও লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদরে পতন হলেও বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর দর বাড়ার কারণে সূচক বাড়তে থাকে।
পুঁজিবাজারে এই দরপতনের পেছনে বাজার নিয়ে বিএসইসির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতভিন্নতার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বাজারে ব্যাংকের যে বিনিয়োগসীমা, সেটি শেয়ারের ক্রয়মূল্যে নাকি বাজারমূল্যে বিবেচনা হবে, বন্ডে বিনিয়োগ এই সীমার ভেতরে থাকবে, নাকি বাইরে থাকবে- এ বিষয়ে একমত হতে পারছে না দুই পক্ষ।
গত ৩০ নভেম্বর দুই পক্ষের বৈঠকে বিষয়টির সুরাহা না হওয়ার পর ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে দুই পক্ষের উপস্থিতিতে আরও একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠক শেষে আরও একটি আলোচনার কথা জানানো হয়। চলতি মাসে বা আগামী জানুয়ারির শুরুতে বৈঠক শেষে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে বলে জানানো হয়।
সেই বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, এনবিআর, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (আইসিবি) মনোনীত প্রতিনিধিসহ অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সেই বৈঠক শেষে যা বলা হয়
সেই বৈঠক শেষে এর সভাপতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং শেয়ারবাজার কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকি কমিটির আহ্বায়ক মফিজ উদ্দীন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে যেসব আলোচনা হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে কথা হয়েছে। এখন চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরও একটি বৈঠক করতে হবে। সেটি চলতি মাসে অথবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে হবে।… ওই বৈঠকে পুঁজিবাজারের জন্য দৃশ্যমান কিছু দেখা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় বিরতির পর আমাদের মধ্যে এই বৈঠক হয়েছে। আমাদের আলোচনায় তথ্য-উপাত্তের বেশ কিছু ঘাটতি ছিল, যা আলোচনায় উঠে এসেছে। এ কারণে আরও একটি বৈঠক করতে হবে।’
পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনা পদ্ধতি আর বন্ডে বিনিয়োগ এই সীমার বাইরে থাকবে কি না- এ নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এগুলো খুবই সেনসিটিভ ইস্যু। এ ব্যাপারে এখনই কোনো কথা বলতে চাইছি না। এর জন্য আপনাদের পরবর্তী বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
টানা পড়ছে পুঁজিবাজার
গত ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে বলে বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানোর পরের দিন পুঁজিবাজারে সূচক বাড়ে ১৪৩ পয়েন্ট।
তবে সেই রাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বিজ্ঞপ্তি উল্টো আতঙ্ক তৈরি করে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বিএসইসির সঙ্গে বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
পরের দিন লেনদেন শুরুই হয় ৮৪ পয়েন্ট পতনের মধ্য দিয়ে। তবে লেনদেন চলাকালেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের আদেশের কপি ছড়ায়। বিএসইসি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিয়ে ৭ ডিসেম্বর বসতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে- এমন খবরে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে লেনদেন শেষ হয় ৮৯ পয়েন্ট বেড়ে। এরপর আরও তিন দিন বাড়ে সূচক।
সব মিলিয়ে ১ থেকে ৭ ডিসেম্বর বৈঠক শুরুর দিন পর্যন্ত সূচক বাড়ে ৩৪৫ পয়েন্ট।
তবে সেই বৈঠক শেষে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না আসার পর পুরো উল্টো চিত্র দেখা দেয়। ১২ কর্মদিবসের মধ্যে কেবল ৯ ডিসেম্বর ৩২ পয়েন্ট এবং ২১ ডিসেম্বর ২০ পয়েন্ট সূচক বাড়ে।
বাকি ১০ কর্মদিবস সূচক পড়ে। এই সময়ের মধ্যে লেনদেনও কমে আসে। ৭ ডিসেম্বরের বৈঠকের দিন ১ হাজার ৩৩১ কোটি ৪ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছিল। সেটি গত ২১ ডিসেম্বর নেমে আসে ৬৫২ কোটি ১ লাখ টাকায়। এরপর কিছুটা বাড়লেও রোববার হাতবদল হয়েছে ৮৮৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা।