বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টালমাটাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান

  •    
  • ২১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:৩০

কয়েক মাস ধরে নানা অনিয়মে টালমাটাল ব্যাংকবহির্ভূত বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অনেক প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখে সময়মতো অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহক। ব্যাংক বা বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান টাকা রাখলেও তা যথাসময়ে ফেরত দিতে পারছে না অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

স্বস্তিতে নেই ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। মূলত অনিয়ম, দুর্নীতি এবং আস্থার সংকটেই এই অবস্থা। এক মাসে আমানত এবং ঋণ স্থিতি বাড়লেও অন্য মাসেই পরিস্থিতি ভিন্ন। উচ্চ সুদ কিংবা নানা ছাড় দেবার পরও প্রতিষ্ঠানগুলো পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত আমানত।

কয়েক মাস ধরে নানা অনিয়মে টালমাটাল ব্যাংকবহির্ভূত বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখে সময়মতো অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহক। শুধু গ্রাহকই নয়, ব্যাংক বা বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান টাকা রাখলেও তা যথাসময়ে তাদের ফেরত দিতে পারছে না অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আমানত না বাড়ায়, দায় পরিশোধেও স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।

চলতি বছরের ৯ মাস শেষে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। আমানত কমেছে ৫৩২ কোটি টাকা। আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমার পাশাপাশি ঋণ স্থিতি বাড়ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। সেপ্টেম্বর শেষে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ৫৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে ঋণ কিছুটা বেড়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার বছরে ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক ছাড় দিয়েছিল। কিন্তু এসব বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতির কারণে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা নাজুক। টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ফলে গ্রাহক আস্থার সংকটে পড়েছেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমানতকারীরা কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, সময়মতো আমানত ফেরত দিতে পারছে না তারা। ফলে নতুন করে অনেকে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। সাধারণ আমানতকারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কিংবা আরেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এসব প্রতিষ্ঠানে আগের মতো আর টাকা রাখছে না। আবার নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণও সময়মতো ফেরত আসছে না। যে কারণে উচ্চ সুদের অফার করেও আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।’

আমানতের প্রায় ৯৩ শতাংশই রাজধানীতে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৩৫ কোটি টাকা, যা জুনে কমে হয় ৪২ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা, তিন মাস আগের তুলনায় যা ২৮২ কোটি টাকা কম। তবে সেপ্টেম্বরে আবার আমানত সামান্য বেড়ে ৪২ হাজার ৯৪১ কোটি টাকায় ওঠে।

গত ৯ মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মেয়াদি আমানত কমে ৪২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকায় নেমেছে, ডিসেম্বরে যা ছিল ৪২ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। অন্যান্য আমানত ৭ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ২৭৮ কোটি টাকা।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখার বেশির ভাগই ঢাকায়, যে কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট আমানতের ৩৯ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা বা ৯২ দশমিক ৯৭ শতাংশ এসেছে ঢাকা বিভাগ থেকে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রাম বিভাগের আমানত রয়েছে ১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা।

রাজশাহী বিভাগ থেকে ৪৬২ কোটি, খুলনা থেকে ৩১০ কোটি, সিলেট থেকে ১৯৯ কোটি, ময়মনসিংহ থেকে ৭৯ কোটি এবং বরিশাল থেকে ৫১ কোটি ও রংপুর বিভাগ থেকে এসেছে ৫৬ কোটি টাকা করে।

এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের বড় একটি অংশের জোগানদাতা হলো ব্যাংক। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ব্যাংকের মতো নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এনবিএফআই) তারল্য সহায়তা দিতে বেশ কিছু নীতি-সহায়তা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যাতে এনবিএফআই থেকে আমানত তুলে না নেয়, সে জন্যও ব্যাংকগুলোকে দফায় দফায় নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ঋণ বিতরণও ঢাকায় বেশি

আমানতের পাশাপাশি লিজিং কোম্পানিগুলোর ঋণ বিতরণও ঢাকায় বেশি।

২০২১ সালের মার্চের শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৬ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। তা জুনে কিছুটা বেড়ে হয় ৫৬ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। কিন্তু সেপ্টেম্বরে ঋণ কমে ৫৬ হাজার ৬১৮ কোটি টাকায় নামে।

সবচেয়ে বেশি ঋণ গেছে শিল্প খাতে, প্রায় ৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ব্যবসা ও বাণিজ্য খাতে ২৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ভোক্তাঋণ ১৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, নির্মাণ খাতে ৯ দশমিক ০৮ শতাংশ, কৃষিতে শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

আমানতের মতো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে আছে রাজধানী। ৮৪ দশমিক ০৯ শতাংশ ঋণই রাজধানী ঢাকার ভেতরের শাখাগুলোতে রয়েছে। এর পরই চট্টগ্রামে ১০ দশমিক ২৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে অনেক ঋণের সুদের হার ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ ছিল। ব্যাংকের ঋণের সুদ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেয়ার পর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদও কমেছে। করোনাভাইরাসের কারণে সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের একটি বড় অংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে। এ জন্য মহামারিতে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণ বেড়েছে।

বেশির ভাগ শাখা শহরাঞ্চলে

বর্তমানে সারা দেশে এনবিএফআইগুলোর শাখা রয়েছে ৮২৩টি। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে ৬৮২ এবং গ্রামাঞ্চলে ২৬৩টি শাখা রয়েছে।

এর মধ্যে চারটি সরকারি এনবিএফআইয়ের শাখা রয়েছে ৫৮টি। বেসরকারি ৩০টি এনবিএফআইয়ের শাখা রয়েছে ২৪৬টি। কর্মসংস্থান ব্যাংক ও আনসার ভিডিপি উন্নয়ন বাংকের ৫১৭টি শাখা রয়েছে।

বিভাগের হিসাবে এসব প্রতিষ্ঠানের ঢাকায় ৩০২টি, চট্টগ্রামে ১৪৬, খুলনায় ৮০, রাজশাহীতে ৮৬, বরিশালে ৪৩, সিলেটে ৫৩, রংপুরে ৫৭ ও ময়মনসিংহে ৫৬টি শাখা রয়েছে।

ব্যাংকের মতো সব ধরনের লেনদেনের লাইসেন্স না থাকলেও বেশ কিছু এনবিএফআই মেয়াদি আমানত নিতে পারে। এ ধরনের এনবিএফআইগুলো নন-ব্যাংক ডিপোজিটরি করপোরেশন হিসেবে বিবেচিত হয়।

অনিয়মের কারণে আস্থার সংকট

বর্তমানে দেশে চারটি সরকারি ও ৩০টি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণের নামে প্রচুর অর্থ বের করার ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে এ খাতের আর্থিক ভিত অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগের পর এ খাতের অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে। এর কিছুদিনের মধ্যে আবার এনআরবি গ্লোবাল ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসে।

এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। অত্যন্ত নাজুক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ করে মন্দ ঋণ এ খাতের পরিস্থিতিকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে, এটি গত এক দশকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।

সব মিলিয়ে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন টাকার সংকটে পড়েছে। ক্রমেই এ খাতের প্রতি আস্থা কমায় আমানত কমছে।

এ বিভাগের আরো খবর