নির্বাচনি সহিংসতায় বিজিবি ল্যান্স নায়েক রুবেল মণ্ডল নিহত হওয়ার ঘটনায় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের গাড়াগ্রাম ইউনিয়নে পরিস্থিতি এখনও থমথমে।
ঘটনাস্থল পশ্চিম দলিরাম মাঝাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আতঙ্ক নিয়ে ফিরতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন শিক্ষকরা।
উপজেলার পশ্চিম দলিরাম, মাঝাপাড়া, বানিয়াপাড়া, দালালপাড়া, নতুন টেপারহাট, শাহপাড়া, ডিসির মোড় এলাকায় শিশুদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে তাদেরকে স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদের আশ্বস্ত করছেন শিক্ষকরা।নির্বাচনি সহিংসতায় ২৮ নভেম্বর গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম দলিরাম মাঝাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নিহত হন বিজিবি'র ল্যান্স নায়েক রুবেল মণ্ডল।এ ঘটনায় ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ললিত চন্দ্র রায়। ঘটনার পর গ্রেপ্তার এড়াতে ওই এলাকার পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান।
সহিংসতার ২০দিনের মাথায় সোমবার সরেজমিনে এলাকায় গিয়ে দেখা মিলেছে কয়েক নারী-পুরুষ ও স্কুল শিক্ষার্থীর।ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক সৌদি আখতার বলেন, ‘২৯ নভেম্বর থেকে চারদিন আমরা একাডেমিক ভবনে ঢুকতে পারিনি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেয়ায় স্কুলের মাঠে গিয়ে হাজিরা খাতায় সই করে ফিরেছি। ১৪ ডিসেম্বর থেকে কিছু শিক্ষার্থী স্কুলে আসা শুরু করে। তাদের স্কুলে আসার প্রবণতা দেখা গেছে মামলার প্রধান আসামি মারুফ হোসেন অন্তিক গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে।’ বিদ্যালয় সূত্র জানায়, সেখানে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২১০। তাদের উপস্থিতির হার অর্ধেকেরও কম। চতুর্থ শ্রেণির ৪০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫-২০ এবং পঞ্চম শ্রেণির ৩৫ জনের মধ্যে স্কুলে যাচ্ছে ১৫-১৬ জন।পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতী আখতার জানায়, স্কুলে আগের মতো আনন্দ নেই। বেশির ভাগ বন্ধু-বান্ধব আসছে না। খেলাধুলা হচ্ছে না। সবাই আতঙ্কে রয়েছে। সুমাইয়া আকতার নামে পঞ্চম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী জানায়, এলাকার অনেক শিক্ষার্থী বাড়িতে নেই। বাবা মায়ের সঙ্গে পালিয়ে আছে। সে কারণে তারা স্কুলে যাচ্ছে না। স্কুলে আসতে চাইলেও ভয়ে যেতে পারছে না অনেকে।মাঝাপাড়া এলাকার মৌসুমী বেগম বলেন, ‘আয় উপার্জন করি সংসার চালায় পুরুষ মানুষেরা। ওমরায় বাড়ি ছাড়া। অনেক দিন হয়া গেলো ভয়ে বাড়ি আইসেছে না। পুলিশ বলি ধরি যাইবে এই জন্যে।’
তিনি বলেন, ‘যারা অপরাধী তাদের ধরুক, আর যারা দোষ করে নাই, ওইলা মানুষোক যেন না ধরে। ভয়ে-আতঙ্কে বাড়ি ছাড়ি পালাইছে মানুষগুলা। অনেক মহিলাও চলি গেইছে। সাথে ছাওয়ালাক নিয়া গেইছে, ওই জন্যে স্কুলে যাবার পায়ছে না ওমরা।’এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আসাদুর রহমান জানান, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি এখনও। পাড়াগুলোতে পুরুষ এমনকি মহিলারাও নাই। অনেকে আবার গরু ছাগল ধরি পালে গেইছে। কিছু মহিলা মানুষ আছে তারাও আতংকে দিন কাটায়ছে। মার্ডার হইছে সবারে মনোত ভয় আছে। সে কারণে বাড়িত নাই।’
তিনি বলেন, ‘নিরপরাধ কেউ যেন গ্রেপ্তার না হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করলে ভীতি অনেকটা কেটে যাবে।’ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন জানান, গুমোট একটা অবস্থা ছিল। নির্বাচনি সহিংসতার পর থেকে বলা যায় পুরো এলাকা মানুষ শূণ্য। এখন এলাকায় মানুষ ফিরতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে শুরু করেছে, তবে সন্তোষজনক নয়।তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে আমরা হোম ভিজিট করছি। তাদের স্কুলে আসতে বলছি। তারা না আসলে পিছিয়ে পড়বে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানান, কিছু মহিলা এলাকায় আসলেও সন্ধ্যা নামার আগে অন্যত্র চলে যান। সন্তানদেরও নিয়ে যান। সকালে ফিরে আসেন।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফা আখতার বলেন, নির্বাচনি সহিংসতার পর কিছুদিন আলামত হিসেবে বিদ্যালয়টি আয়ত্বে রেখেছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এখন তাদের আয়ত্বে নেই। বিদ্যালয় খোলা হচ্ছে এবং শিক্ষকরা নিয়মিত যাচ্ছেন, তবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে ঘাটতি রয়েছে। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের হোম ভিজিট করার নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।২৮ নভেম্বর ইউপি নির্বাচনে কেন্দ্রটিতে ফল পরিবর্তনের দাবিতে পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মারুফ হোসেন অন্তিক চাপ প্রয়োগ করেন নির্বাচন কর্মকর্তাদের ওপর। এ সময় ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় নিহত হন বিজিবি ল্যান্স নায়েক রুবেল মন্ডল।সহিংসতার ঘটনায় মামলায় মারুফকে প্রধান আসামি করা হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার আশুলিয়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।এ বিষয়ে জানতে কিশোরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আউয়ালের মোবাইল ফোনে কল দেয়া হয়েছে, তিনি রিসিভ করেননি।
নীলফামারীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান জানান, মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত চলছে। সহিংসতায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টাও চলছে। নিরাপরাধ মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তাও দেখা হবে।