বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ব্যাংক না হয়েও ‘ব্যাংক’: বন্ধ হয় না প্রতারণা  

  •    
  • ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ১২:২৭

সরকারি নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে অন্তত ছয়টি সমবায় প্রতিষ্ঠান তাদের নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দ যুক্ত করে সংগ্রহ করছে আমানত। খুলছে একের পর এক শাখা। সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করছে তারা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি কমিটি এসব বন্ধে পথ খুঁজছে।

তফসিলি ব্যাংকের মতো খোলা হচ্ছে সাধারণ সঞ্চয় ও চলতি হিসাব। সংগ্রহ করা হচ্ছে‌ মেয়াদি আমানতও। ব্যাংক না হলেও প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে ‘ব্যাংক’ শব্দটি। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ নামক সমবায় প্রতিষ্ঠান এসব তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও।

সমবায় প্রতিষ্ঠান হয়েও নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দ যুক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ‘আজিজ কো অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’। অনিয়ম ও দুর্নীতিতে এরই মধ্যে ডুবেছে এই প্রতিষ্ঠান। বন্ধ হয়ে গেছে কার্যক্রম। টাকা না পেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন শত শত গ্রাহক।

ব্যাংক শব্দই যেন গ্রাহক টানার অস্ত্র। ব্যাংক না হলেও নামের সঙ্গে তাই শব্দটি জুড়ে দেয়ার প্রবণতা।

আবার অনেকে সমবায়, এনজিও, অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান খুলে জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে। তারপর একসময় এসব প্রতিষ্ঠান হয়ে যাচ্ছে লাপাত্তা।

সন্দেহজনক লেনদেন, অর্থ সংগ্রহ এবং অস্পষ্ট ব্যবসা বন্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায়, তার জন্য কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুপারিশ আকারে আদালতে প্রতিবেদন পাঠাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে জানান, ‘অবৈধ এবং সন্দেহজনক লেনদেন বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আইনগত পদক্ষেপ ছাড়াও সাধারণ মানুষকে সতর্ক হতেও প্রচারণা চালানো হয়। তবে এবার সুনির্দিষ্ট করে পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হবে। এ ক্ষেত্রে আইনের নির্দিষ্ট ধারা পরিপালনের কথাও তুলে ধরা হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটউট অফ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট, বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্টে ব্যাংক না হয়েও ব্যাংক শব্দ যুক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনা করলে শাস্তির বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব বিষয়ে কঠোর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয় না। বন্ধের ক্ষেত্রে সদিচ্ছা থাকা জরুরি।’

মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ

আইনে স্পষ্ট বলা আছে, কোনো সমবায় সমিতির নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দ যুক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। অথচ সেই কাজটিই করছে ‘দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’। সমবায় অধিদপ্তর থেকে সতর্ক করা হলেও তা আমলে নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সুপারিশ করেছে সমবায় অধিদপ্তর।

দি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড নাম দিয়ে দেশব্যাপী ১২৮টি শাখা খুলে চলছে ব্যবসা। অভিযোগ আছে তফসিলি ব্যাংকের মতো সাধারণ সঞ্চয় হিসাব, চলতি হিসাব, মেয়াদি আমানতসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে এই সমবায় প্রতিষ্ঠান।

অথচ ২০১৩ সালের সমবায় সমিতি সংশোধিত আইনে বলা আছে, সমবায় সমিতি হিসেবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের নামের শেষে ‘ব্যাংক’ শব্দ যুক্ত করা যাবে না। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুমোদন দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভের এসব কর্মকাণ্ড বন্ধে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছে সমবায় অধিদপ্তর। সেখানে বলা হয়, আইনের তোয়াক্কা করছে না মার্কেন্টাইল কর্তৃপক্ষ।

ব্যাংকিং লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও ‘ব্যাংক’ শব্দের ব্যবহার এবং অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর এবং ব্যাংকিং বিভাগের সচিবকে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

ওদিকে ব্যাংক শব্দ ব্যবহার করতে সমবায় আইনের ধারা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছে মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি। এটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দিয়েছে সমবায় অধিদপ্তর। এসব বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানের করপোরেট অফিসে গেলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

আজিজ কো-অপারেটিভ লিমিটেড

গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না আজিজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শাখা অফিস। সঞ্চয় ফেরত পেতে প্রধান অফিসে প্রতিদিনই ধরনা দিয়েও কূল-কিনারা পাচ্ছেন না অনেকে। টাকা দেয়া হবে- এমন আশ্বাসে কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর।

কর্তৃপক্ষ জানায়, মূলধন সংকটের কারণে জটিলতায় পড়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এই সমবায়ের সঙ্গে লেনদেনে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

১৯৯৮ সালে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন নেয় আজিজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। তারপর প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশের প্রায় ৬ হাজার সদস্যের কাছ থেকে আমানত তুলেছে ৬১৫ কোটি টাকা। কিন্তু দাবির টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে না। সমবায় প্রতিষ্ঠান হলেও নামের সঙ্গে ব্যাংক শব্দ যুক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আজিজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড।

ব্যাংক শব্দ ব্যবহার করে ছয় সমবায়

সরকারি নির্দেশনার তোয়াক্কা করছে না অন্তত ছয়টি সমবায় প্রতিষ্ঠান। যারা নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দ যুক্ত করে সংগ্রহ করছে আমানত। খোলা হচ্ছে একের পর এক শাখা। সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করায় বাড়ছে উদ্বেগ।

সমবায় অধিদপ্তরের তৈরি করা এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান হচ্ছে: দি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড, দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড, দি স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড, আজিজ কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড।

এ ছাড়া মার্চেন্ট কো-অপারেটিভ ব্যাংক ও ক্রিসেন্ট মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে আবার দি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ, মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ, আজিজসহ কয়েকটির বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে উধাও হওয়ার অভিযোগ আছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমবায় অধিদপ্তর থেকে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান সেটার তোয়াক্কা করছে না, বরং হাইকোর্টে রিট করে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি কাজ স্থবির করে দিয়েছে।

গ্রাহকের অর্থ লুট করে যারা

২০০৬ সালে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক গ্রাহকদের কাছ থেকে নিয়ে যায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ইউনিপে টু ইউ নেয় ৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালে ডেসটিনি হাতিয়ে নেয় গ্রাহকের ৫ হাজার কোটি টাকা।

২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ২৬৬টি সমবায় সমিতি গ্রাহক বা সদস্যদের কাছ থেকে ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা নিয়ে যায়।

কী সুপারিশ করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে কমিটি। ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৯ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ধারা অনুযায়ী, ব্যাংক ব্যবসা না হয়েও ব্যাংকিং সেবা দিলে সাত বছর পর্যন্ত জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধও করে দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এই কমিটি নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের বিভিন্ন স্থানে গজিয়ে ওঠা অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হতে পারে বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রক এই সংস্থা।

বিআইবিএমের সাবেক ডিজি ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘অর্থ তছরুপ হচ্ছে, ব্যাংক শব্দ যুক্ত করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে, অথচ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করলে নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হস্তক্ষেপও চাইতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’

এ বিভাগের আরো খবর