দুজনের প্রেম ও বিয়েটা অনেকটাই ছিল নাটকীয়। পরিণতিটা হলো মর্মান্তিক।
মাত্র ১৫ দিনের পরিচয়ে বিয়ে করেন কানাডা প্রবাসী ইফতেখার আবেদীন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের এলমা চৌধুরী। তবে সংসার সুখের হয়নি। শেষ হলো প্রাণহানির মধ্য দিয়ে।
এপ্রিলের শুরুতে বিয়ের তিন মাসের মাথায় ইফতেখার চলে যান কানাডায়। এলমা থেকে যান শ্বশুরবাড়ি। স্বামী ফেরার পর সুখের দেখা পাননি, উল্টো পাঁচ দিন পর মৃত্যু হয় তার। শ্বশুরবাড়ি বলছে আত্মহত্যা, এলমার পরিবার বলছে হত্যা।
গত মঙ্গলবার দুপুরের পর এলমাকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাটি গণমাধ্যমে আসে রাতে।
মেয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন এলমার বাবা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। মেয়েকে মৃত অবস্থায় দেখে অভিযোগ করেন, তার মেয়েকে খুন করা হয়েছে।
প্রেম ও বিয়ে যেভাবে
এলমার তিনজন স্বজন ও একাধিক সহপাঠীর সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার। তারা জানিয়েছেন সম্পর্ক ও বিয়েটা কীভাবে হয়েছিল।
সহপাঠী আবদুল্লাহ জানান, গত মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ফেসবুকে তাদের পরিচয়। একপর্যায়ে দুইজন প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। আর সম্পর্কের তিন দিনের মধ্যে তারা বিয়ের আলোচনায় চলে যান।
তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে ১৫ দিনের মধ্যেই এই বিয়ে হয়। সেটির আবার আয়োজন হয় পারিবারিকভাবে।’
এলমার ফুফাতো বোন রেহানা সুলতানা বলেন, ‘বিয়ের আগে এলমাকে নানা আশ্বাস দেয়া হয়। বিয়ের পর কানাডায় নিয়ে যাবে, ছোট বোনের পড়াশোনার দায়িত্ব নেবে, এমন আরও অনেক কিছু।
‘কিন্তু বিয়ের পর এলমা তার পরিবার, স্বজন, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত না। স্বামী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিত না।’
বন্ধুরা জানান, বিয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসতে পারতেন না এলমা। পরীক্ষা দিতে আসার সময় শ্বশুরবাড়ির কেউ না কেউ থাকত। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলাফেরার পুরোটা সময় ভিডিওকলে তার স্বামীকে দেখাতে হতো।
এলমার চাচা গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইফতেখার সন্দেহপ্রবণ ছিল। এই সন্দেহ করা নিয়ে ঝামেলা চলছিল। ওকে যে মারধর করা হয়, তা বোনদের জানিয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারায় এই পরিণতি হলো।’
ইফতেখার ফেরার তৃতীয় দিনেই মৃত্যু
দুজনের বিয়ে হয় গত ২ এপ্রিল। তিন মাস পর জুলাইয়ে কানাডা ফিরে যান ইফতেখার। পাঁচ মাস ধরে এলমা বনানী-২ নম্বর সড়কের ৪৪ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গেই থাকতেন।
প্রায় পাঁচ মাস পর ইফতেখার ফেরেন গত ১১ ডিসেম্বর। তিন দিনের মাথায়ই মৃত্যু হলো এলমার।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, ইফতেখার দেশে ফেরার পর এলমাকে মারধর করা হয়েছে। সুরতহালেও উঠে এসেছে এলমার হাত, পা, মুখ, গলা, পিঠে আঘাতের চিত্র। আঘাতের জখম রয়েছে শরীরজুড়ে। এসব চিহ্ন সাম্প্রতিক বলেই মনে করছে বাহিনীটি।
এলমার বাবা সাইফুল ইসলাম জানান, ইফতেখার যে দেশে ফিরেছেন, এ বিষয়টি তাদের জানানোও হয়নি। বুধবার হাসপাতাল থেকে ইফতেখারের ফোন কল পেয়ে প্রথম জানতে পারেন তার জামাতা এখন বাংলাদেশে।
এলমার বিষয়ে জানাতে ইফতেখার প্রথমে ফোন করেন তার শাশুড়ির নম্বরে। তখন মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ৩টা।
তাদের বাড়ি সাভারের ধামরাইয়ে। সেখান থেকে তারা ইউনাইটেড হাসপাতালে পৌঁছন সন্ধ্যা ৫টার দিকে। সেখানে গিয়ে মেয়ের মৃতদেহ পান। ওই সময় ইফতেখার ও তার বাবা মো. আমিন উপস্থিত ছিলেন।
হত্যা না আত্মহত্যা
পুলিশের কাছে শ্বশুরবাড়ির দাবি, আত্মহত্যা করেছেন এলমা।
বনানী থানার কর্মকর্তারা জানান, ইফতেখার তাদের জানিয়েছেন, মঙ্গলবার এলমার সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। এ সময় তার স্ত্রী বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ও অন্যরা বাধা দেয়ায় তিনি বের হতে পারেননি।
স্বামীর দাবি, বাধা পেয়ে নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন এলমা। এরপর দরজা ভেঙে ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে খবর দেয়। আমরা গিয়ে এলমাকে মৃত অবস্থায় পাই। পরবর্তী সময়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফ্যানের সঙ্গে বাঁধা ওড়না উদ্ধার করেছি। বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
তবে এলমার চাচা গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ও আত্মহত্যা করতে পারে না। ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন তারা নাটক সাজাচ্ছে।’
এলমার বাবা সাইফুল ইসলাম যে মামলা করেছেন, তাতে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, বিয়ের পর ইফতেখার ও তার বাবা-মা এলমার পড়াশোনা বন্ধ করতে বলেছিল। কিন্তু তা মানেনি এলমা। সে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এ জন্য তাকে নির্যাতন সহ্য করতে হয়।
এজাহারে বলা হয়েছে, ‘আমার মেয়ের নাকে কালচে দাগ, ওপরের ঠোঁটে কালচে দাগ, বাম কানে কাটা চিহ্ন, ঘাড়ে লম্বালম্বি কালচে জখম, গলার উপরিভাগে থুতনিতে কালচে জখম, পিঠের ডান পাশে কলচে জখম এবং ফোলা, পিঠের ডান পাশে রক্ত জমাট ও ফোলা, ডান ও বাম হাতের বিভিন্ন জায়গায় কালো জখমের ছপছপ দাগ এবং ডান ও বাম হাতের আঙুলে কাটাছেঁড়া, দুই পায়ের হাঁটুর নিচে কালচে জখম ও ছপছপ দাগ, বাম পায়ের বুড়ো আঙুল ছিল।’
এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে ইফতেখার আবেদীনকে। সঙ্গে আছেন শিরিন আমিন ও মো. আমিন। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মো. আমিন ইফতেখারের সৎবাবা।
সাইফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়ে পড়া বন্ধ করতে না চাইলে ইফতেখার ও তার পিতা-মাতা মেয়েকে শারীরিক নির্যাতন করে মাথার চুল কেটে দেয় এবং সাংসারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে।’
পুলিশ কী বলছে
হাসপাতাল থেকে বনানী থানায় খবর দেয়া হলে পুলিশ এসে সন্দেহভাজন হিসেবে এলমার স্বামী ইফতেখারকে আটক করে এবং মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
মঙ্গলবার রাতে এলমার বাবা মামলা করার পরই ইফতেখারকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। বুধবার আদালতে তোলার পর তাকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়।
এই মামলায় তিনজনের নাম থাকলেও ইফতেখারের বাবা-মাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল হাসান ফিরোজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘ইফতেখার ও এলমার মধ্যে মারামারি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। মেয়েটির শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাকে কেন মারধর করা হয়েছে এবং কীভাবে মৃত্যু হয়েছে, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পারিবারিক কলহ, মারধরসহ অন্য বিষয়গুলো সামনে রেখেই তদন্ত চলছে। আমরা গ্রেপ্তার আসামিকে রিমান্ডে পেয়েছি। রিমান্ডে সেসব তথ্য জানার চেষ্টা করব।