বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিবাহিত হওয়ায় হলের সিট হারাচ্ছেন ঢাবি ছাত্রীরা

  •    
  • ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৯:২৯

অধ্যাপক ড. নাজমুন নাহার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটি রুমে সাতজন শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি একজন অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে থাকে তখন মেয়েটির পাশাপাশি বাকি শিক্ষার্থীদেরও সমস্যা হয়। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটি বাসায় থাকলে যে রকম রিল্যাক্সে থাকতে পারবে, হলে কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। আর বিবাহিত মেয়েরা থাকবে স্বামীর সংসারে। সে কেন হলে থাকবে? স্বামী যদি অন্য কোথাও থাকে তাহলে স্বামীকে স্ত্রীর জন্য কোনো শেল্টার খুঁজে দিতে হবে।’

বিবাহিত হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে এক শিক্ষার্থীর সিট কেটে দিয়েছে হল প্রশাসন। বিবাহিত হওয়ায় আরও কয়েকটি হলেও নারী শিক্ষার্থীদের সিট বাতিল করা হচ্ছে।

ভুক্তভোগীদের একজন জানান, ১২ নভেম্বর হলের সিট বরাদ্দ কমিটির একজন শিক্ষক বিবাহিত হওয়ায় তার সিট কেটে দেন। ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তবে তিনি তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়েছেন।

ঘটনার বিষয়ে ওই শিক্ষার্থী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সনাতন ধর্মাবলম্বী। করোনার বন্ধে আমার বিয়ে হয়। বন্ধের পর যখন আমি হলে আসি তখন ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী স্বামীর মঙ্গল কামনায় শাখা-পলা-সিঁদুর পরি।

‘হল খোলার প্রথম দিন বিষয়টি একজন ম্যামের নজরে আসার পর তিনি আমি বিবাহিত কি না জানতে চান। আমি বিবাহিত বললে তিনি আমার নাম মার্ক করে রাখেন। এরপর ১২ নভেম্বর আমার ফ্লোরের ইলা ইসমাইল ম্যাম আমার সিট কেটে দেন। যখন আমার সিট কাটা হয় তখন আমার পরীক্ষা চলছিল।’

তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি ম্যামের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করি। তবে সেটি সম্ভব হয়নি। পরে আমি হলের অন্য এক ম্যামকে বলি, ম্যাম আমার সিটটা বেশি প্রয়োজন। ঢাকায় আমার থাকার জায়গা নেই। আমার হাজবেন্ড পটুয়াখালীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সেও শিক্ষার্থী। সে সেখানেই থাকে। আমাকে একটু হলে রাখার ব্যাপারে সাহায্য করা যায় কি না। তবে ওই ম্যামও কোনো সাহায্য না করে উল্টো অপমানসূচক কথা বলেন।’

ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘হলের অনেকেই বিবাহিত, কিন্তু বিয়ের বিষয়টি তাদের গোপন রাখতে হয়। কেবল হলের সিট বাঁচিয়ে রাখতে। বিয়ে তো কোনো অপবিত্র কাজ নয়, যে কেউ বিবাহিত হলে সেটি লুকিয়ে রেখে তাকে চলতে হবে।’

এ বিষয়ে কুয়েত মৈত্রী হলের সিট কমিটির সদস্য এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ইলা ইসমাইল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের যে রকম নির্দেশনা দিয়েছেন, সেভাবেই আমরা হলটি চালাই।’

এ রকম নিয়ম কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই নিয়ম আমরা বানাইনি। এটি প্রশাসন থেকে আসা এমন একটি নিয়ম যেটি অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। আমরা শুধু সেটি অনুসরণ করি।’

শুধু কুয়েত মৈত্রী হলের ঘটনায় নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রী হলে বিবাহিত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশিত হলে শিক্ষার্থীদের সিট হারাতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হল সংসদের সাবেক সহসভাপতি তাসনিম আফরোজ ইমি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে হলের একজন আবাসিক ছাত্রীকে বিবাহিত হওয়ার কারণে হল প্রশাসন দ্বারা হেনস্তার অভিযোগ করেন।

সেখানে তিনি লেখেন, ‘সেই ছাত্রীর বোন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি হলে আবাসিক হওয়ার সাক্ষাৎকার প্রদান করতে এলে তার বড় বোন বিবাহিত এবং হলে থাকে, এটি তিনি প্রকাশ করেন আর এতে হলের হাউস টিউটর ক্ষেপে যান। পরবর্তী সময়ে এই হাউস টিউটর নির্দেশ প্রদান করেন বড় বোন হল না ছাড়লে ছোট বোন হলে উঠতে পারবে না।’

কোন শিক্ষক এই নির্দেশ দিয়েছেন জানতে চাইলে তাসনিম আফরোজ ইমি নিউজবাংলাকে বলেন, দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক নুসরাত তাসনীম।

অভিযোগের বিষয়ে নুসরাত তাসনীম বলেন, ‘কথাটা আসলে সেভাবে বলা হয়নি। প্রথম বর্ষের সেই শিক্ষার্থী যেহেতু মেধা তালিকায় সিট পেয়েছে তার সিট হবে। আমি সেদিনই এই শিক্ষার্থীকে বলেছি, তার বড় বোনের বিষয়টি আমরা আপাতত স্কিপ করছি। সে যদি লোকাল গার্ডিয়ান নিয়ে আসতে পারে তার সিট হবে।’

লোকাল গার্ডিয়ান বড় বোন হলে সমস্যা কী জানতে চাইলে তিনি হলটির প্রাধ্যক্ষ ড লাফিফা জামালকে ফোন দিতে বলেন।

ড. লাফিফা জামালকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তার ফোন সংযোগ পাওয়া যায়নি।

বিবাহিত হওয়ার কারণে হল খোলার পর অক্টোবরে আরও এক শিক্ষার্থীর সিট কেটে দেয় শামসুন্নাহার হল প্রশাসন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘অক্টোবরে হল খোলার পর আমার ফ্লোরের হাউস টিউটরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। উনাকে আমি বিবাহিত হওয়ার কথাটা বলি। তিনি বলেন, যেহেতু তুমি বিবাহিত, তোমার ব্যাপারটা প্রাধ্যক্ষ ম্যামের সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে।

‘আমি বলেছি, ম্যাম আমার পরীক্ষা চলছে। এই পরীক্ষার সময়টা আমাকে একটু কনসিডার করার জন্য আমি ম্যামকে অনুরোধ করি। এরপর একদিন তিনি আমাকে ফোন করে জানান, আমার সিট কাটা হয়েছে। পরে আমি আর হলে থাকতে পারিনি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য পাঁচটি আবাসিক হল রয়েছে।

এসব হলের আসন বণ্টন সম্পর্কিত নীতিমালার একটি ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ছাত্রী বিবাহিত হলে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। অন্যথায় নিয়মভঙ্গের কারণে তার সিট বাতিল হবে। শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহিত ছাত্রীকে চলতি সেশনে হলে থেকে অধ্যয়নের সুযোগ দেয়া হবে। অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রী হলে থাকতে পারবেন না।’

বিবাহিত হওয়ায় সম্প্রতি শামসুন্নাহার হল এবং বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের দুই ছাত্রীর সিট নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। সেই প্রেক্ষাপটে এ নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পাঁচ ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরা।

সোমবার এসব হলের শিক্ষার্থীদের কয়েকজন প্রতিনিধি এই নিয়ম বাতিলের আবেদন জানিয়ে উপাচার্যের কাছে যান।

শিক্ষার্থীরা এই নিয়ম ছাড়া আরও কয়েকটি দাবি উপাচার্যের কাছে উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো, শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মর্যাদা রক্ষায় সব ছাত্রী হলে ‘লোকাল গার্ডিয়ান’ বা ‘স্থানীয় অভিভাবকের’ পরিবর্তে ‘ইমার্জেন্সি কন্টাক্ট’ বা ‘জরুরি যোগাযোগ’ শব্দটি রাখা, আবাসিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা যেকোনো ধরনের হয়রানি এবং অসহযোগিতামূলক আচরণ বন্ধ করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া এবং শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকা সাপেক্ষে অনাবাসিক ছাত্রীদের হলে প্রবেশের অধিকার পুনর্বহাল করা ও জরুরি প্রয়োজনে তাদের হলে অবস্থান করতে দেয়া।

শিক্ষার্থীরা জানান এসব দাবির প্রেক্ষিতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান তাদের বলেছেন, হল কর্তৃপক্ষ ও ডিনস কমিটির সভায় আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কোনো পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত এ নিয়মটিই বহাল থাকবে।

এমন নিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নাজমুন নাহার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একজন মেয়ে যখন বিবাহিত হয় তখন তার একটি সোশ্যাল লাইফ হয়। সে কিন্তু একজন স্বাভাবিক ছাত্রীর মতো থাকতে পারে না। আর অন্তঃসত্ত্বা হলে তো আরও অনেক রকম পরিবর্তন আসে। যেটি হলে থেকে করা সম্ভব নয়। এই নিয়মটা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। আমরা শুধু পুরোনো জিনিসটাই প্র্যাকটিস করে যাচ্ছি।’

প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘একটি রুমে সাতজন শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি একজন অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে থাকে, তখন মেয়েটির পাশাপাশি বাকি শিক্ষার্থীদেরও সমস্যা হয়। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটি বাসায় থাকলে যে রকম রিল্যাক্সে থাকতে পারবে, হলে কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। আর বিবাহিত মেয়েরা থাকবে স্বামীর সংসারে। সে কেন হলে থাকবে? স্বামী যদি অন্য কোথাও থাকে তাহলে স্বামীকে স্ত্রীর জন্য কোনো শেল্টার খুঁজে দিতে হবে।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি এই নিয়মের পক্ষে। কারণ হলগুলো এক-একটি হোস্টেল, বাসা না। হোস্টেলটা হোস্টেলের মতোই থাকতে হবে। তাই আমরা বিবাহিত এবং অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের হলে থাকাকে ডিসকারেজ করছি।’

হলের নীতিমালায় বলা আছে, ‘শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহিত ছাত্রীকে চলতি সেশনে হলে থেকে অধ্যয়নের সুযোগ দেয়া হবে।’

এই বিশেষ ক্ষেত্র কখন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো মাস্টার্সের শিক্ষার্থী যদি তার অ্যাকাডেমিক জীবনের শেষ মুহূর্তে থাকে আর সে যদি বিবাহিত হয় তখন আমরা তাকে থাকার সুযোগ দেব। কারণ আমরা যদি তাকে থাকার সুযোগ না দিই, হয়তো তার ডিগ্রিটা কমপ্লিট হবে না। এসব ক্ষেত্রে আমরা এটিকে কনসিডার করি।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হলগুলো সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হয়। সমাজ, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ধারণ করে সে নিয়মনীতি করা। শিক্ষার্থীরা যেহেতু দাবি তুলেছে, আমরা সেগুলোকে আমলে নিয়েছি। সুতরাং যুগের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ বা কোথাও কোনো অসংগতি আছে কি না, সেগুলো পর্যালোচনা করে আমাদের বুঝতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর