সমুদ্রপথে ট্রানজিট সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে বন্দরকেন্দ্রিক বড় অঙ্কের আয়ের সুযোগ থেকে এখনও বেশ দূরে বাংলাদেশ। কারণ বিশ্বের বড় বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল) সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না। ফলে এসব জাহাজের পণ্য বন্দরের জেটিতে আনতে দরকার পড়ে একাধিক মাঝারি (সিস্টার ভেসেল) কিংবা ছোট (লাইটার) জাহাজের। এতে পণ্য খালাসে ঝুঁকি ও জটিলতার পাশাপাশি বাড়ে ব্যয়ও।
একই কারণে বন্দরকেন্দ্রিক অন্যান্য বাণিজ্যে (যেমন: বড় বড় জাহাজ রিফুয়েলিং) পিছিয়ে বাংলাদেশ, তবে আশা জাগাচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প। এটি বাস্তবায়ন হলে সমুদ্র অর্থনীতিতে নতুন যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাবে ভারত, নেপাল, ভুটানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো। এতে ট্রানজিট মাশুল থেকে বিপুল রাজস্ব আয়ের দ্বার উন্মোচন হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, একটি জাপানি কোম্পানি গভীর সমুদ্রবন্দরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে। এতে সময় লাগবে বছরখানেক।
২০২২ সালের শেষের দিকে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ গুছিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পুরোদমে শুরু হবে গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ। কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালের মধ্যে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গভীর সমুদ্রবন্দর হলে ভবিষ্যতে মাতারবাড়ী হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড।
গভীর সমুদ্রবন্দরের আলোচনা যখন শুরু
চট্টগ্রাম বন্দরের সূচনা ১৮৮৭ সালে। এ বন্দরের জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ গভীরতা হয় সাড়ে ৯ মিটারের মতো। ফলে সেখানে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। এ অবস্থায় দেশে যে বাড়তি গভীরতার বন্দর দরকার, তা প্রথম উপলব্ধিতে আসে ১৯৭৮ সালে।
চট্টগ্রাম বন্দরের পুরোনো এক প্রকাশনায় দেখা যায়, ওই বছর নেদারল্যান্ডস ইকোনমিক ইনস্টিটিউট নামের একটি সংস্থা ১১টি স্থান পরিদর্শন করে কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে গভীর পানির টার্মিনাল নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সুপারিশ করে। যদিও সেই উদ্যোগ আর বাস্তবায়ন হয়নি।
এরপর ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন এটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে। পরে আলোচনায় আসে পটুয়াখালীর পায়রা। সবশেষে সিদ্ধান্ত হয় কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ীতেই হবে গভীর সমুদ্রবন্দর। অবশেষে গত বছরের মার্চে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। আগামী বছরের জুলাইয়ে শুরু হবে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ।
যে প্রক্রিয়ায় কাজ এগোচ্ছে
মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ দুই ধাপে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয়েছে। এ ধাপে সম্পন্ন হবে নকশা প্রণয়ন ও দরপত্রের প্রক্রিয়া। আর দ্বিতীয় ধাপে নির্মাণ হবে একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল ও একটি কনটেইনার টার্মিনাল। একই সময়ে চলবে চ্যানেল তৈরির কাজও।
পুরো প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। শুরুতে ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে কাজ শুরু হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি হবে গভীর সমুদ্রবন্দর। কেননা কোনো বন্দরে ১৪ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ার সক্ষমতা থাকলেই সেটিকে গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে ধরা হয়। মাতারবাড়ীতে ১৮ মিটার গভীরতার জাহাজও ভিড়তে পারবে।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প এলাকা। ছবি: নিউজবাংলাযেসব কারণে গভীর সমুদ্রবন্দর
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে বাড়তি চাপ সামলানো কঠিন হচ্ছে। বন্দরটির অবকাঠামোগত সক্ষমতা তেমন একটা বাড়ানোরও সুযোগ নেই। তাই একটি গভীর সমুদ্রবন্দর এখন সময়ের দাবি।
দেশের নতুন ইকোনমিক জোনগুলো পুরোদমে চালু হলে শিল্পপণ্য আমদানি-রপ্তানি ব্যাপক হারে বাড়বে। এমন বাস্তবতায় গভীর সমুদ্রবন্দর অনেকটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে দুই থেকে আড়াই হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারে। আর গভীর সমুদ্রবন্দরে সহজেই ভিড়তে পারবে ৮ থেকে ১০ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে বর্তমানে নদীপথে যুক্ত। পরে সড়ক ও রেলপথও যুক্ত হবে।
মাতারবাড়ী নিয়ে জাপানভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সমীক্ষায় বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মাতারবাড়ী টার্মিনালে সমুদ্রপথে প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে খরচ কমবে ১৩১ ডলার। আর ৪০ ফুট কনটেইনারে কমবে প্রায় ২০০ ডলার।
জাপানের বিগ-বি মাতারবাড়ীতে
এর আগে অনেক দেশ বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর বানানোর আগ্রহ দেখালেও সবশেষ জাপান হাজির হয় ‘বিগ বি’ ধারণা নিয়ে, যা ‘দ্য বে অফ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ হিসেবে পরিচিত। এ কৌশলগত পরিকল্পনায় ওই এলাকায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বন্দর, যোগাযোগ, শিল্পাঞ্চলসহ সমন্বিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়। এর বাস্তব রূপ দিতে ২০১৬ সালে জাইকা একটি জরিপ চালায়, যাতে মাতারবাড়ীতে বন্দর নির্মাণের পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ নেয়, যা যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
যদিও চট্টগ্রাম বন্দরের আওতাধীন হওয়ায় নথিপত্রে এটিকে মাতারবাড়ী টার্মিনাল বলা হচ্ছে। কার্যত এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর।
প্রকল্পে ব্যয় কত
গভীর সমুদ্রবন্দরের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। আর ৮ হাজার ৮২০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বন্দর নির্মাণে। প্রকল্প ব্যয়ের ১২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা স্বল্প সুদে ঋণ দিচ্ছে জাপান।
গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকার চিত্র
কর্ণফুলী নদী থেকে সাগরপথে মাতারবাড়ীর দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। সেখানে গিয়ে দেখা মেলে ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নৌপথের। সাগর থেকে উপকূল পর্যন্ত পাথর দিয়ে তৈরি বাঁধ থাকায় নৌপথে তেমন ঢেউ নেই। এতে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানোয় পাওয়া যাবে বাড়তি সুবিধা।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায় পানি পুরো নীল। দেশের আর কোনো বন্দরে এমন নীল পানি নেই। নীল পানি থাকা মানে নৌপথের বড় অংশে পলি জমার আশঙ্কা কম।
এই নৌপথে ঢোকার ডান পাশে যেখানে বন্দর নির্মাণ হবে, সেখানে এখনও স্থাপনা নেই। কিছুদূর পরপর চোখে পড়ল লাল কাপড় টাঙানো ছোট্ট খুঁটি। আছে ছোট একটি টাওয়ার। নৌপথের এই পাশে একটি ৩০০ মিটার এবং আরেকটি ৪৬০ মিটার জেটি নির্মাণ হবে। এই দুটি জেটি নিয়েই হচ্ছে প্রথম টার্মিনাল।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সময়মতো টার্মিনালের কাজ শেষ হলেও পণ্য পরিবহনের পুরোপুরি সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে এক থেকে দেড় বছর। কারণ টার্মিনাল থেকে সড়কপথে পণ্য আনা-নেয়ার জন্য প্রায় ২৮ কিলোমিটার সড়ক প্রস্তুত হবে বন্দরের প্রথম জেটি নির্মাণের দেড় বছর পর। বর্তমানে সড়কের নকশা প্রণয়ন ও জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাপানি কোম্পানি বন্দরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর প্রতিবেদন দিলে আগামী বছরের শেষের দিকে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। আশা করি এরপর চার বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে। আর এটি হলে বড় বড় জাহাজ একেবারে বন্দরের টার্নিমালে ভিড়তে পারবে। এতে পণ্য ওঠানো-নামানোর খরচ কমে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভোক্তারাও লাভবান হবেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমরা উন্নত দেশের যে স্বপ্ন দেখছি, তার ভিত্তি তৈরি করবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। এটি ব্যবহার করে শুধু আমরাই না, পাশের বেশ কয়েকটি দেশও উপকৃত হবে।
‘গভীর সমুদ্রবন্দরে যেহেতু বড় বড় জাহাজ ঢুকতে পারবে, সেহেতু আমাদের দেশেই বড় বড় জাহাজের মালিক গড়ে উঠবে। বড় বড় জাহাজের ব্যবসা গড়ে উঠবে। শুধু তা-ই নয়, এসব জাহাজ তৈরির কারখানাও গড়ে উঠবে। সব মিলিয়েই এই মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর আমাদের অর্থনীতির পথনকশা বদলে দেবে।’
একই এলাকায় চলমান কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় গভীর সমুদ্রবন্দরের বেশিরভাগ কাজ হয়েই আছে। পরে আর কিছু কাজ করলেই এটি শতভাগ গভীর সমুদ্রবন্দরে রূপান্তর হবে।’
তিনি জানান, ২৫০ মিটার প্রশস্ত বন্দরের চ্যানেলটি আরও ১০০ মিটার বাড়ানোর কাজ চলছে। বর্তমানে যে প্রশস্ততা রয়েছে, সেখানে প্যানাম্যাক্স ভেসেল ঢুকতে পারে। এরই মধ্যে ৩৭টি বড় মাদার ভেসেল এখানে পণ্য খালাস করেছে।