বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ফের বাড়ছে। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অনেকটাই কমে আসায় আবারও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে তেলের বাজার।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মঙ্গলবার অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম আগের দিনের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ বেড়েছে। এদিন ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলার ছাড়িয়ে ৭২ ডলার ৫৬ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। আর ব্রেন্ট তেলের দর উঠেছে ৭৬ ডলার ৯৫ সেন্টে।
ওমিক্রন আতঙ্কে নভেম্বরের শেষে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট তেলের দাম কমতে কমতে ৬৬ ডলারে নেমে এসেছিল। ব্রেন্ট তেলের দর নেমে এসেছিল ৬৮ ডলারে।
তিন-চার দিন এই একই জায়গায় স্থির ছিল তেলের বাজার। কিন্তু ওমিক্রন ৩৮টি দেশে ছড়িয়ে পড়লেও কেউ মারা না যাওয়ায় এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক বেশ খানিকটা কেটে যায়। এতে বিশ্বে তেলের চাহিদা বাড়বে-এ সম্ভাবনাকে সামনে রেখে আবার বাড়তে শুরু করে দাম। গত এক সপ্তাহের মধ্যে মঙ্গলবারই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আশঙ্কা করা হয়েছিল, অতিসংক্রামক ওমিক্রন বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে; কমে যাবে তেলের চাহিদা। সে কারণেই দরপতন হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ওমিক্রন ততটা মারাত্মক হবে না; উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বা আতঙ্কও খুব একটা ছড়াবে না। তাই, এখন দাম আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।
ওমিক্রন আতঙ্কে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বড় দরপতন হয় ২৭ নভেম্বর। ওইদিন ব্যারেলপ্রতি সাড়ে ১০ ডলার বা ১৩ শতাংশের বেশি পড়ে যায় দাম। ২০২০ সালের এপ্রিলের পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সবচেয়ে বড় দরপতন ছিল ওটি।
রয়টার্স জানিয়েছিল, কোভিড-১৯ এর নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরও কমে যেতে পারে। বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, করোনার এই নতুন ধরনের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট দেখা দিতে পারে। কমে যেতে পারে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তার ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের চাহিদাও কমে যেতে পারে। আর এই ভয়েই তেলের দামে বড় পতন হয়।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
গত ২৭ অক্টোবর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৮৫ ডলার ছাড়িয়ে ৮৫ দশমিক ০৭ ডলারে ওঠে। এরপর থেকেই তা কমতে থাকে। ৮ নভেম্বর এর দর ছিল ৮২ দশমিক ৫ ডলার। এক মাস আগে ১৬ অক্টোবর দাম ছিল ৮০ ডলার। আর এক বছর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ কোম্পানি ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সও মাস তিনেক আগে তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছিল, কোভিড-১৯ এর কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় যে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছিল তা দূর হচ্ছে। পাশাপাশি দেশে দেশে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে এ বছরের জানুয়ারি মাসে জ্বালানি তেলের দাম ছিল গড়ে প্রতি ব্যারেল ৪৯ ডলার। এরপর থেকে গড়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৩ ডলার, মার্চে ৬০, এপ্রিলে ৬৫, মে মাসে ৬৪, জুনে ৬৬, জুলাইয়ে ৭৩ এবং আগস্টে ৭৪ ডলার। অক্টোবর মাসে এই দাম ৮৫ ডলার ছাড়িয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছিল, শিগগিরই তা ১০০ ডলার হয়ে যেতে পারে।
তবে গত নভেম্বর থেকে দাম নিম্নমুখী হয়। তারপরও দামটা নিয়ন্ত্রণে আসছিল না। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনতে নিজ দেশের পেট্রোলিয়াম ভাণ্ডার থেকে পাঁচ কোটি ব্যারেল তেল বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
গত ২৩ নভেম্বর টুইট বার্তায় বাইডেন ঘোষণা দেন, ‘আমেরিকান পরিবারগুলোর জন্য তেল ও গ্যাসের দাম কমাতে পদক্ষেপের কথা আজ ঘোষণা করছি। আমেরিকাবাসীর জন্য স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ (এসপিআর) থেকে পাঁচ কোটি ব্যারেল তেল ছাড়ব আমরা, যাতে তেল ও গ্যাসের দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে।’
দেশে তেল ও গ্যাসের মতো জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি রুখতে এই পদক্ষেপ নেন জো বাইডেন। এর জেরে সে দেশে জ্বালানির দাম কমবে বলে মনে করা হচ্ছিল। পাশাপাশি বিশ্ব জুড়ে জ্বালানির দামেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছিলেন অনেকে।
তবে বাইডেনের এই ঘোষণার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম খুব একটা কমেনি। ওমিক্রন আতঙ্কেই মূলত বড় দরপতন হয়।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর অজুহাতে গত ৪ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ সরকারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করে।