বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘রাজনৈতিক ইন্ধনে’ ফের সন্ত্রাসের পথে

  •    
  • ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:৫৩

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, শুধু কালারমারছড়া ও কুতুবজোম ইউনিয়ন ঘিরে নতুন করে গড়ে উঠেছে রশিদ আহমদ গ্রুপ, আব্বাস গ্রুপ, হশশাবর গ্রুপ, জিয়াউর রহমান জিয়া গ্রুপ ও বদাইয়া গ্রুপ। এসব দলের সদস্যদের মধ্যে অর্ধশতাধিক আত্মসমর্পণ করা দস্যু, যারা প্রকাশ্যে বা গোপনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ১০ থেকে ১২ জনের নাম এরই মধ্যে পুলিশের তালিকাতেও উঠে এসেছে।

কক্সবাজারের মহেশখালী-কুতুবদিয়ার দেড় শতাধিক জলদস্যু ২০১৮-১৯ সালে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এ আত্মসমর্পণের মূল লক্ষ্য ছিল দ্বীপ উপজেলায় শান্তি ফিরিয়ে আনা। আর অপরাধ জগৎ ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসার বার্তা ছিল জলদস্যুদের।

তবে বছর দুয়েক না যেতেই এসব এলাকায় দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। আত্মসমর্পণ করা সেই দস্যুদের একটি বড় অংশ ফের সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়েছে। কয়েকজনের নাম ফের উঠেছে পুলিশের তালিকাতে।

অভিযোগ, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ইন্ধনে নতুন করে গড়ে উঠেছে কয়েকটি বাহিনী। এসব বাহিনীর অর্থের জোগানও দিচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত এক মাসে প্রাণ গেছে আত্মসমর্পণ করা দুই জলদস্যুর। এসব হত্যাকাণ্ডে নাম এসেছে আরেক জলদস্যু গ্রুপের। তারাও ২০১৮ সালে অস্ত্র জমা দিয়েছিল।

২০১৯ সালে ৯৬ জলদস্যুর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শান্তি ফিরেছিল মহেশখালীর আলোচিত ইউনিয়ন কালারমারছড়ায়। সেই ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি তারেক বিন ওসমান শরীফ। নির্বাচিত হওয়ার পর সন্ত্রাস দমনে সুনাম কুড়িয়েছেন। তবে ইউপি নির্বাচনকে সামনে রেখে তাকেও পড়তে হচ্ছে সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে।

তিনি বলেন, ‘ইউপি নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক একটি গোষ্ঠী আত্মস্বীকৃত দস্যুদের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ, যার প্রমাণ মিলেছে গেল এক মাসে দুই দস্যু হত্যাকাণ্ডে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দস্যুরাই এসব তথ্য জানিয়েছে।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, শুধু কালারমারছড়া ও কুতুবজোম ইউনিয়ন ঘিরে নতুন করে গড়ে উঠেছে রশিদ আহমদ গ্রুপ, আব্বাস গ্রুপ, হশশাবর গ্রুপ, জিয়াউর রহমান জিয়া গ্রুপ ও বদাইয়া গ্রুপ। এসব দলের সদস্যদের মধ্যে অর্ধশতাধিক আত্মসমর্পণ করা দস্যু, যারা প্রকাশ্যে বা গোপনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ১০ থেকে ১২ জনের নাম এরই মধ্যে পুলিশের তালিকাতেও উঠেছে।

মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হাই নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সব আত্মস্বীকৃত দস্যু যে সন্ত্রাসে জড়িয়েছে তা বলা ঠিক হবে না। তবে ১০-১২ জন আমাদের তালিকাতেও আছে। এ ছাড়া সম্প্রতি দুই দস্যু হত্যাকাণ্ডেও বেশ কয়েকজনের নাম এসেছে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন তারা।’ তিনি জানান, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মূলত ফের দলগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। এসব দল পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সম্প্রতি দুজন কর্মকর্তাসহ ১৫ পুলিশ সদস্যের একটি ক্যাম্প করা হয়েছে কালারমারছড়ায়। এত দিন থানা থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরের ইউনিয়নটি অনেকাই ঝুঁকিতে ছিল। মহেশখালীতে সবার প্রথমে অস্ত্র জমা দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন কালারমারছড়ার ‘কালাবদা বাহিনী’র প্রধান নুরুল আলম ওরফে কালাবদা। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অস্ত্র জমা দিয়েছি শান্তির পথে ফেরার জন্য, কিন্তু অস্ত্র নেই সবাই জানে, নতুন করে কেউ টার্গেট করতে পারে, এই ভয়ে রাতে ঘুম হয় না।

‘আলোর পথে ফেরার কথা বলে অনেকে এখনও সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত। নিয়মিত অপরাধ সংঘটনের পাশাপাশি নিজের সহযোদ্ধাকেও হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। আতঙ্ক আর ঘুমহীন রাত কাটে এখন আমাদের।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য মতে, ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মহেশখালী-কুতুবদিয়াসহ কক্সবাজার অঞ্চলে ১৮৭টি অভিযান চালিয়ে ২০৮ জলদস্যু ও অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। জব্দ করা হয় দেশি-বিদেশি ৬৮২টি অস্ত্র এবং ৭ হাজার ৯৯০টি গুলি। র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ওই সময় ১১ দস্যু নিহত হন।

এরপর সাংবাদিক ও পুলিশের মধ্যস্থতায় মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপকূলের ছয়টি বাহিনীর ৪৩ জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। তারা তখন জমা দিয়েছিলেন ৯৪টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৭ হাজার ৬৩৭টি গুলি।

এ ছাড়া ২০১৯ সালে পুলিশের মধ্যস্থতায় আত্মসমর্পণ করে ১২ বাহিনীর ৯৬ জলদস্যু। তারা জমা দেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১৫৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৮৪ রাউন্ড গুলি, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ বিভিন্ন যন্ত্র।

২০১৯ সালে জলদস্যুরা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১৫৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৮৪ রাউন্ড গুলি ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম জমা দেন।

এরপর প্রায় দুই বছর দস্যুদের নিয়ে তেমন কোনো কথা শোনা যায়নি। তবে গত ১ জুলাই রাতে মহেশখালীর মাতারবাড়ির কোহেলিয়া নদীতে পাওয়া যায় আত্মসমর্পণ করা জলদস্যু একরামুল হকের মরদেহ। ময়নাতদন্তে তার শরীরে মিলে আঘাতের চিহ্ন।

ওই সময় একরামের মামা ও ইউপি সদস্য লিয়াকত আলী দাবি করেছিলেন, একরাম আত্মসমর্পণ করায় ক্ষিপ্ত ছিলেন দলের সদস্যরা। কবির ডাকাত নামের একজনকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে সহযোগিতা করেছিলেন একরাম। তার দলের লোকজনই একরামকে হত্যা করেছে।

সবশেষ ৫ নভেম্বর রাতে মহেশখালীর কালারমারছড়ায় আলাউদ্দিন নামের আরেক জলদস্যুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিলেন আলাউদ্দিন।

ওই হত্যাকাণ্ডে পুলিশ ও র‌্যাব আত্মসমর্পণ করা জলদস্যু গ্রুপ আয়ুব আলী বাহিনীর প্রধান আয়ুব আলীসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। আয়ুব আলীর দেয়া তথ্যে জব্দ করা হয় ১০টি অস্ত্র ও গুলি। তাদের কাছ থেকেই রাজনৈতিক ইন্ধনে নতুন করে সন্ত্রাসী দল গড়ার বিষয়টি জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

প্রথম ধাপে ৪৩ জলদস্যুর আত্মসমর্পণে মধ্যস্থতাকারী ও যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মহসিনুল হাকিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুন্দরবনেও জলদস্যুরা আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের যেভাবে নজরদারিতে রাখা হয়েছে, মহেশখালীর ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। যার ফলে রাজনৈতিক মদদে হয়তো তারা আবারও ভুল পথে ফিরে যাচ্ছে।

‘আত্মসমর্পণের শুরুতে বিষয়টি আমরা বুঝেছিলাম। কারণ সুন্দরবনে শুধু জলদস্যুতা ছিল, কিন্তু মহেশখালীতে তার ভিন্ন চিত্র ছিল। মূলত এখানকার জলদস্যুরা রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত ছিল।’ আরেক মধ্যস্থতাকারী সাংবাদিক আকরাম হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক ইন্ধনের বিষয়টি সামনে এলেও মূলত তারা গোষ্ঠীগত বিরোধে সন্ত্রাসবাদে ফিরছে বলে মনে হচ্ছে। আমি নিজেই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।

‘আত্মস্বীকৃতদের অনেকে এলাকায় ফিরে আধিপত্য করতে চাচ্ছেন। যার ফলে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে বলে মনে হচ্ছে। আমরা প্রশাসনকে বলেছি, যারাই অন্ধকার জগতে পুনরায় ফিরতে চায়, তাদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে।’

আত্মসমর্পণের মধ্যস্থতায় থাকা র‌্যাব-৭-এর তৎকালীন কক্সবাজার কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেশির ভাগ দস্যু এখনও নিজেদের ধরে রেখেছেন স্বাভাবিক জীবনে, কিন্তু কয়েকজন নিজেদের অপরাধে জড়িয়ে ফেলেছে বলে শোনা যাচ্ছে।

‘আলোর পথে ফেরা কেউ সন্ত্রাসবাদে যেতে পারবে না, এটা তাদের শর্ত দেয়া হয়েছিল। আমরা তাদের বিষয়ে কাজ করছি।’

এ বিভাগের আরো খবর