যেকোনো খাদ্যদ্রব্যে অতিরিক্ত চর্বি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে জারি করা প্রবিধানকে স্বাগত জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন।
এসব সংগঠন বলছে, খাদ্যদ্রব্যে মাত্রাতিরিক্ত চর্বি বা ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ করা গেলে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা যাবে। এর ফলে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হবে।
নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ অনুযায়ী জারি করা ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ এর গেজেট প্রকাশ হয় চলতি সপ্তাহের শুরুতে।
এই প্রবিধান অনুযায়ী, সর্বোস্তরের খাদ্যদ্রব্য উৎপাদক বা ব্যবসায়ীদের আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, মোড়কাবদ্ধ খাদ্য, মোড়কবিহীন খাদ্য, সরাসরি খাওয়ার উপযোগী খাদ্য, যেকোনো তেল ও চর্বি, খাদ্য তৈরির ব্যবহৃত কাঁচামাল অথবা মানুষের খাওয়ার যোগ্য ও অনুমিত যেকোনো খাদ্য বা খাদ্য অংশের জন্য এই প্রবিধানমালা কার্যকর হবে।’
ট্রান্স ফ্যাটি এসিডের মাত্রা খাদ্যের লেভেল বা মোড়কে উল্লেখ বাধ্যতামূলকও করা হয়েছে প্রবিধানে। এছাড়া হাইড্রোজেনেটেড তেল বা পিএইচও কোন মাত্রায় রয়েছে তাও উল্লেখ করতে হবে।
এই প্রবিধিান বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। সংস্থার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, খাদ্যে ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ঘোষিত সর্বোত্তম নীতি হচ্ছে- কোনো খাদ্যে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ ট্রান্স ফ্যাটি এসিড (প্রতি ১১০ গ্রাম ফ্যাটে ২ গ্রাম ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) থাকতে পারে। এর বেশি মাত্রা থাকলে পণ্যটি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এই নীতি বাস্তবায়নেই প্রবিধানমালাটি জারি করেছে।
ওই কর্মকর্তা জানান, পূর্ব ঘোষিত সময় ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে লক্ষ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন বছর থেকেই খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, বাজারজাতকারী সব শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হবে। নির্দিষ্ট সময়ের পর সবার জন্য প্রবিধানটি বাধ্যতামূলক হবে। কেউ আইন ও প্রবিধান লঙ্ঘন করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে জনস্বাস্থ্য ও ভোক্তা স্বার্থ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান), ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশ এবং কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব)।
এসব সংগঠনের দাবি, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ট্রান্স ফ্যাট ঘটিত হৃদরোগে মারা যান। ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে তরুণ ও মাঝবয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এর অন্যতম কারণ। প্রবিধানটি বাস্তবায়িত হলে দেশে হৃদরোগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের রিজিওনাল ডিরেক্টর বন্দনা শাহ্ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই নীতি হৃদরোগ ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এবং এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশকে একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করবে।’
বিষয়টিকে ভোক্তাস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ‘মাইলফলক’ হিসেবে দেখছেন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান। প্রবিধানমালা সঠিকভাবে প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, জিএইচএআই এর বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মুহাম্মাদ রুহুল কুদ্দুস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ট্রান্স ফ্যাটমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত হলে চিকিৎসা ব্যয় কমবে, একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের খাদ্যপণ্যের চাহিদা বাড়বে।’
২০১৯ সালে পরিচালিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও (পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল) ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্যের ৯২ শতাংশে ২ শতাংশের চেয়ে বেশি ট্রান্স ফ্যাট রয়েছে। ২০২০ সালে ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রান্স ফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।
প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে হৃদরোগে মৃত্যুর ৪.৪১ শতাংশের জন্য দায়ী ট্রান্স ফ্যাট। প্রবিধানমালাটি ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩.৪ অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’