নটর ডেম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) যে ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হয়েছিলেন, তা চালাচ্ছিলেন একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। চালকের পরিবর্তে ময়লা বহন করা গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তিনি।
মো. রাসেল নামের ওই ব্যক্তি একসময় সিটি করপোরেশনের মাস্টার রোলে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন।
তবে মাস্টার রোলের ওই চাকরিটি চলে যাবার পর রাসেল কীভাবে গাড়ির চালক হয়ে গেলেন তা জানা যায়নি। আটকের পর রাসেল পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, তার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, তবে তা তিনি দেখাতে পারেননি।
রাসেল কী হিসেবে কাজ করতেন তা স্পষ্ট জানাতে পারেনি দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ঘটনার তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাতেই সব তথ্য উঠে আসবে বলে জানান ডিএসসিসির একাধিক কর্মকর্তা।
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গুলিস্তানে হল মার্কেটের কাছে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের দ্বিতীয় ছাত্র নাঈম হাসান নিহত হন। তার গ্রামের বাড়ী লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার সমষপুর মিয়াজীবাড়ী গ্রামে। পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন তিনি।
ঘটনার পরপরই গাড়ির চালক রাসেলকে আটক করে পুলিশ। রাসেলকে আসামি করে ঢাকা মহানগর পুলিশের পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। বাদী হয়েছেন নিহত নাঈমের বাবা শাহ আলম।
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সালাউদ্দিন মিয়া মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সড়ক পরিবহন আইনের ৬৬, ১০৫ ও ৭৮ ধারায় মামলাটি হয়েছে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ডিএসসিসির গাড়ির তুলনায় চালকের সংকট রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চালক পদে নিয়োগ নেই। এই সংকটকে পুঁজি করে একটি চক্র চালক নয় এমন ব্যক্তি দিয়েও সিটি করপোরেশনের গাড়ি চালাচ্ছে।
তিনি জানান, রাসেল একসময় সিটি করপোরেশনের মাস্টার রোলে ক্লিনারের কাজ করতেন। এখন তিনি ক্লিনার হিসেবেও সেখানে নেই।
তবে কীভাবে কার মাধ্যমে গাড়িটি রাসেল চালাচ্ছিলেন তা জানাতে পারেননি তিনি।
সিটি করপোরেশনের ময়লার এই ট্রাকটির প্রকৃত চালক তিনি নন তা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন মো. রাসেল।
রাসেলের বরাত দিয়ে থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বদলি চালক হিসেবে রাসেল সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। তার কাছে কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়নি।
নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে ডিএসসিসি। সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের জানান, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা সিতওয়াত নাঈমকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির দুই সদস্য হলেন জিএম ট্রান্সপোর্ট ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।
কমিটি তদন্তে নেমে দুটি বিষয়ের ওপর জোর দেবে। দুর্ঘটনাটি কীভাবে সংঘটিত হলো তা সবিস্তারে উত্থাপন ও দোষীদের চিহ্নিত করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে সুপারিশ দেয়া।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে গাড়ির চালকের পরিচয়সহ সব বিষয় উঠে আসবে বলে মনে করেন আবু নাছের।
নাঈম হাসান মৃত্যুর প্রতিবাদে বিকেল সোয়া ৩টার দিকে গুলিস্তানের পুলিশ বক্সের পাশে বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে অবস্থান নেন নটর ডেমের শিক্ষার্থীরা। এতে সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মতিঝিল, পল্টন, জিরো পয়েন্ট এলাকায় দেখা দেয় তীব্র যানজট।
ডিএসসিসির গাড়ির চাপায় সহপাঠীর নিহতের ঘটনায় দোষীদের বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে গুলিস্তান মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন নটর ডেমের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সাইফুল ইসলাম/নিউজবাংলা
আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা নাঈম হত্যার বিচার ও নিরাপদ সড়ক দাবিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ’, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ স্লোগানে বিক্ষোভ করছেন। বিকেল ৫টা পর্যন্ত তারা গুলিস্তান, শাপলা চত্বর এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে নিহত শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পরিবারের কাছে নাঈমের মৃতদেহ হস্তান্তর করে পুলিশ।
নিহতের বড় ভাই মুনতাসির মামুন বলেন, ‘ভাইয়ের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছি কামরাঙ্গীরচরের ঝাউলাহাটি এলাকায়। সেখানে জানাজা শেষে তার মৃতদেহ লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার মিয়াজী বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হবে।’
কামরাঙ্গীরচরের ঝাউলাহাটিতে নাঈমের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে সেখানে যান দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
মেয়র বলেন, আসলে সন্তানহারা পিতা-মাতাকে তো সান্ত্বনা দেয়া যায় না। আমার নিজেরও দুই সন্তান। নিজেই উপলব্ধি করি, এটা কি রকম বেদনাদায়ক-মর্মান্তিক ঘটনা। এই কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
ঘাতক চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করে মেয়র ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘এ রকম গাফিলতি, কোনো অন্যায় বরদাশত করা হবে না। আমরা এরই মাঝে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ব্যবস্থা নেয়া আরম্ভ করেছি। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি এবং আমরা এরই মাঝে তাদের চিহ্নিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা এবং প্রাতিষ্ঠানিক যে কার্যক্রম আছে সেগুলোও আমরা নেব। যাতে করে সুষ্ঠুভাবে বিচার সম্পন্ন হয় এবং সর্বোচ্চ শাস্তি যেন হয়, সেটাই আমরা কামনা করি।’