১২ বছর বয়সে তাজরীন ফ্যাশনে কাজ নিয়েছিল গোপালগঞ্জের রূপা আক্তার। পারিবারের আর্থিক অনটনের কারণে সপরিবারে ঢাকায় এসেছিল তারা। চার বছর পর রূপা যখন কৈশোরে পা দিয়েছে তখন তার জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়।
হঠাৎ আগুনে হতচকিত হয়ে পড়ে রূপা। চার তলার টয়লেট থেকে বেরিয়ে সে সবাইকে ছোটাছুটি করতে দেখে । জীবন বাঁচাতে অনেকে জানালা দিয়ে যে যার মতো লাফিয়ে নিচে পড়ে। রূপাকেও তার ফ্লোরের এক ছেলে লাফ দিতে বলে। সে লাফ দিতে অসম্মতি জানায়।
তারপর কীভাবে রূপা নিচে লাফিয়ে পড়েছিল, তা আর জানা নেই। নিচে পড়ে এক পায়ের মধ্যে রড ঢুকে যায়, মাথা ও বুকে প্রচণ্ড আঘাত পায়। পরে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনের ভবনে ভয়াবহ আগুনে ১১৪ শ্রমিক নিহত হন। বুধবার এই ট্র্যাজেডির ৯ বছর পূর্ণ হলো। এ দিনে নিশ্চিন্তপুরের বাতাসে ভাসছিল হাজারো শ্রমিকের বাঁচার আর্তনাদ। আগুনে অঙ্গার হয়েছিল অসহায় শ্রমিকরা।
৯ বছর আগে সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা কেড়ে নিয়েছে রূপার স্বাভাবিক জীবন। সেই থেকে তার জীবনে স্বপ্নের বাতি আর জ্বলে ওঠেনি। তখন থেকে শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তিনি। অল্প সময় হেঁটে চলাফেরা করতে পারলেও উঠতে বসতে যন্ত্রণা বাড়ে।
কিশোরী থেকে বেড়ে ওঠা তরুণী রূপা কারখানাতেও কাজ নিতে পারেন না। টুকিটাকি সংসারের কাজে সাহায্য করেন। মা মরিয়ম বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতার কারণে সংসারও বাঁধা হয়নি রূপার। পাত্রপক্ষ কেউ এলে দাবি করে দুই-তিন লাখ টাকা৷
ওই ঘরে বসে নিউজবাংলাকে এসব কথা বলেন রূপা।
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে কবির হোসেনের ভাড়া বাড়ির ছোট কক্ষে রূপা ও তার মায়ের সংসার। খাট নেই, তাই মেঝেতে বিছানো চটেই রাত কাটাতে হয় তাদের। থালাবাসন ঘরের এক কোণে মেঝেতে সাজানো। কাপড়চোপড় ঝোলানো দড়িতে।
রূপা বলেন, ‘ওই ঘটনার পর অনেক দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আইএলও থেকে ৩ লাখ টাকা সাহায্য পাইছিলাম। ওই টাকা চিকিৎসার পেছনেই শেষ। বাড়িতে বসতভিটাও বিক্রি করতে হইছে চিকিৎসার জন্য। তাই এখানেই (নিশ্চিন্তপুর) কষ্ট করে থাকি।’
তিনি বলেন, ‘তাজরীন ফ্যাশনের আগুন আমার জীবনের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। পায়ে সমস্যার কারণে এখনও আমার বিয়ে হয় নাই। আমি তো অচল মানুষ। আমার টাকা নাই দেইখা আমার বিয়ে হয় না।’
মেয়েকে নিয়ে অসহায় মা মরিয়ম বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্যামনে দিন কাটে হেইডা আমি জানি। শরীর খারাপ হলে যেদিন কামে যাইতে পারি না, সেদিন আর ঘরে চুলা জ্বলে না৷ খাইয়া না খাইয়া মাইয়াডারে নিয়া থাকি। ঘরের মধ্যে একটা খাটও নাই। শীতে মাইঝাতেই চট আর পাটি পাইতা শুই। ঠান্ডায় অনেক কষ্ট হইলেও কী করমু?
'মাইডারে (রূপা) অনেক শখ কইরা তাজরীনে দিছিলাম। ওর খালায় চাকরিডা নিয়া দিছিল। আগুনে সব শ্যাষ হইয়া গেল। মাইয়াডারে অচল কইরা দিল। খোঁড়ায় খোঁড়ায় হাঁটে৷ নানান সমস্যার কারণে বিয়া হয় না মাইয়াডার। যারাই দেখবার আসে, টাকা চায়। কেউ দুই, কেউ তিন লাখ টাকা চায়। ক্যামনে জোগামু এত ট্যাকা। আর ক্যামনেই বা বিয়া দিমু মাইয়াডারে। দুনিয়ার কোন মায়ে মাইয়ারে তার সামনে শ্যাষ হইতে দেখব!'